Dinajpur Days: ব্রিটিশ আমলের ট্রেন আর সামাদ, চতুর্থ পর্ব

Dinajpur Daysসবুজঘেরা পার্বতীপুর

সুচরিতা সেন চৌধুরী: এখানে আসার আগে জানতে পেরেছিলাম, সামাদ কিন্তু থাকতেন দিনাজপুরেরই পার্বতীপুরে (Dinajpur Days)। আমাদের আস্তানাও ছিল এই পার্বতীপুরেই। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি প্রয়াত হন তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত। তখন তাঁর বয়স ৬৮-৬৯। অবিভক্ত ভারতের হয়ে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। তাঁর সম্পর্কে কোথাও তেমন ভাবে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। বোনের ফিল্ড ভিজিটের পাশাপাশি আমারও সামাদের খোঁজ চলতে থাকে। বোনের সঙ্গে আমরাও চলেছি অনেক জায়গায়। সবুজে ঘেরা সেই সব প্রত্যন্ত গ্রাম। মাটির ঘর। গ্রাম্য মানুষ, তাঁদের বেঁচে থাকা, জীবিকা—সব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল সে সময়।

কিন্তু সামাদের কথা যাকেই জিজ্ঞেস করছি, হতাশ হচ্ছি। কেউ কিছুই বলতে পারছেন না। এই প্রজন্ম তাঁকে জানে না বোঝা গেল। সেই সময় ত্রাতা হয়ে এলেন এক রিকশাচালক। এতটাই মরিয়া ছিলাম সামাদের অস্তিত্ব খুঁজে বার করতে যে, রিকশাচালককেও কথায় কথায় বলে ফেলি। তিনিই তখন আমাকে সটান নিয়ে হাজির করেন সামাদের কবরের সামনে। গা ছমছমে এলাকা। দিনের আলো অস্তমিত। আমরা ক’জন ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও। কবরের চারদিকে আগাছা জন্মেছে। বেদীর রং চটে গিয়েছে। কোনাগুলো ভেঙে গিয়েছে। তার মধ্যে থেকেই উঁকি দিচ্ছে ফুটবলার সামাদ— সঙ্গে জন্ম ও মৃত্যু দিন। আশার আলো দেখা দিল সেখান থেকেই।

দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা থেকে শুরু করে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার মধ্যেই আরও একটা অনবদ্য অভিজ্ঞতা হল। আর সেটা হল ব্রিটিশ আমলের ট্রেন। এখনও সেই একই ট্রেন চলে দিনাজপুরের বিভিন্ন রুটে। সিনেমায় বা ছবিতে দেখা ট্রেনের সঙ্গে একটুও অমিল নেই। পুরো দিনাজপুর সফরে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় এই ট্রেনেই যাতায়াত করেছি প্রায় প্রতিদিন লোকাল ট্রেনের মতো। লাল রঙের ছোট ছোট কামরা। জানলা দিয়ে বাইরে ঝুলছে ঝুড়ি, গামছা ইত্যাদি ইত্যাদি। ছাদেও লোক উঠতে দেখেছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম আধুনিক হয়েছে কিন্তু দিনাজপুর ছবিতে দেখা ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও।

Dinajpur Days

পার্বতীপুর রেল স্টেশন ও ফুটবলার সামাদ

সেই ট্রেনে যাতায়াতের পথেই এক দিন জানতে পারলাম, এই দিনাজপুর স্টেশনেরই স্টেশন মাস্টার ছিলেন সামাদ। আরও একটা ক্লু পাওয়া গেল। যে স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছিলাম সেই স্টেশনেই হেঁটে বেড়াতেন সামাদ, ভেবেই শিহরিত হলাম। তখন তিনি চাকরী করতেন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়েজে। সটান হাজির হলাম বর্তমান স্টেশন মাস্টারের কাছে। তিনিই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করলেন। এক জনকে সঙ্গে দিলেন আমাকে সামাদের নাতনির বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সামাদের বংশের মানুষ বলতে নাতনিই রয়েছেন বলে জানা গেল। সেই নাতনির বাড়িতে অনেকটা সময় কাটল। কিন্তু পুরোদস্তুর একটা লেখা করার মতো উপাদান পাওয়া গেল না। তবে উপকার হল অনেকটাই।

ফেরার পথে যে রেল কোয়ার্টারে সামাদ থাকতেন, সেটা দেখলাম। কোয়ার্টারের সামনে বিশাল সবুজ মাঠে আজও ফুটবল খেলছে কত ছেলে। পরে অবশ্য সামাদকে নিয়ে লেখার সময় প্রদীপদা (পিকে ব্যানার্জি) তথ্য দিয়ে সাহায্য না করলে লেখাটাই দাঁড়াত না। সে গল্প অন্য কখনও বলব। সেই সামাদ যিনি একবার ইংল্যান্ডের সমারসেট ফুটবল দলের বিরুদ্ধে খেলে চমকে দিয়েছিলেন। খেলেছেন অবিভক্ত অবিভক্ত ভারতীয় দলের হয়ে। প্রদীপদার কাছে শুনেছিলাম ব্রিটিশ ফুটবলাররা তাঁর পায়ে হাত দিয়ে দেখেছিলেন। তাঁর পায়ের পাতার গড়ন নাকি ছিল অন্যরকম । তাঁকে বলা হত ভারতীয় ফুটবলের জাদুকর। তাঁকে নিয়ে লিখতে বসলে এমনই আরও কয়েকটা পর্ব লাগবে। যদিও প্রদীপদার থেকে নতুন করে সে গল্প শোনারও আর সুযোগ নেই। তাই স্মৃতি আর পুরনো প্রকাশিত লেখাই সম্বল।

Dinajpur Days

দিনাজপুরের লোকাল ট্রেন

ঘোরার মাঝে মাঝে লেখার জন্য যে তিনটে লক্ষ্য নিয়ে গিয়েছিলাম তা সম্পূর্ণ করতে পেরে ভাল লাগছিল। আসলে নিজেকেই নিজের টার্গেট দেওয়া আর তাতে সফল হতে পারলে, তার থেকে ভাল কিছু আর হতে পারে না। দিনাজপুর পর্ব শেষে এবার ফিরে যাওয়ার পালা ঢাকা। সেখানে আরও দু’দিন কাটিয়ে নিজের দেশ, নিজের চির চেনা কলকাতায় ফেরার দিন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে।

(চতুর্থ পর্ব)

ছবি: সংগৃহীত

Days At Chittagong: যেখানে মিলেছে সমুদ্র-পাহাড়, তৃতীয় পর্ব

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle