বসুধারা: যেটুকু জল ঝর্না হয়ে ঝরছে, তা-ও আবার তুষার হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই

বসুধারাবসুধারা

লেখনী পঞ্চাধ্যায়ী


‘চলতে চলতে কত দূর চলে এলাম।
হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলাম কত পথ,
ভোরের সদ্য ফোটা আলো চোখে নিয়ে যে হাঁটার শুরু,
এখনও গোধূলি বিকেলে সে যাত্রা চলছে…’

যাত্রা তো চলবেই। কারণ, এ পথে হাঁটা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। এমনকি, দেখা মেলে না কোনও ঘোড়ার। তবে এই ভাল! না হলে ভিড়ভাট্টায় পাহাড়ের অনেক দুর্গম অঞ্চলেও আজ নির্জনতার বড্ড অভাব। তবে, ঘোড়া থাকলে বেশ উপলব্ধি করা যায় যে, এ এক নিঃসঙ্গ-নিস্তব্ধতার মোড়কে মোড়া দুর্গম যাত্রাপথ!

রাতের বদ্রিনাথের তাপমাত্রা ছিল মাইনাস এক বা দু’ডিগ্রির কাছাকাছি। তবুও খুব ভোরে সুখের কম্বল ছেড়ে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম ‘পাপ-পুণ্যের’ হিসেবটা চুকিয়ে আসার জন্য।

কী ভাবছেন? পাপ-পুণ্য হিসেব করার কোনও মেশিন তৈরি হল কি না? ভাবনাটা খুব একটা অবান্তর নয়! সত্যিই তো… আমরা বর্তমানে যে ভাবে যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছি! লাই ডিটেক্টর, নারকো টেস্ট… কত কী! একটা মানুষ মিথ্যে বলছে কি না তা-ও আজ যন্ত্র দ্বারা নির্ধারিত। তা হলে আশা করা যায় ‘পাপ-পুণ্য’ হিসেবেরও কোনও এক ব্যবস্থা অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই হবে। তবে যাই হোক, এ যাত্রায় আমার দর্শনের বিষয়টি কোনও যন্ত্র নয়।

সকাল থেকেই মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ টের পাচ্ছিলাম! আর হবে নাই বা কেন? প্রায় তিন বছরের এক লম্বা অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে আর কিছু ক্ষণ পরে। অন্যের কাছে কতই না শুনেছি তার কথা, তার অহংকার, রূপের গাম্ভীর্য, সে নাকি ধরাই দেয় না সবার কাছে, কেবল ভাগ্যবানেরাই তার স্পর্শ পায়।

যাহ্… দেখেছেন তো, কথায় কথায় বলতেই ভুলে গেছি যে, আমি যাচ্ছি কোথায়! আমার গন্তব্য বসুধারা। এ এক বরফের ঝর্না। প্রচলিত বিশ্বাস যে, পাপীরা এই ঝর্নার জলের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়। মানা গ্রাম থেকে প্রায় সাত কিলোমিটারের দুর্গম হাঁটা পথ। আর বদ্রিনাথ থেকে মানার দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। তিব্বতের পথে এটি ভারতের শেষ বসতি। তাই, যাত্রাপথে ‘লাস্ট ইন্ডিয়ান টি শপ’ লেখা প্ল্যাকার্ডও চোখে পড়ে। এ ছাড়া এই জায়গা মহাভারত বিখ্যাত। কারণ, এই গ্রামেরই এক গুহায় ব্যাসদেব ও গনেশের যৌথ মেলবন্ধনে রচিত হয়েছিল বেদ, যা আজ ব্যাসগুহা ও গনেশগুহা নামে খ্যাত।

সেই গুহা ছাড়িয়ে এক কিলোমিটার এগোলে দেখা মেলে আর এক ঐতিহাসিক জায়গা ভীমপুলের। মহাপ্রস্থানের সময় দ্রৌপদী সরস্বতী নদী পেরোতে না পারায় ভীম নিজের হাতে একটা মাত্র পাথর ফেলে এই সেতু তৈরি করেন। এখানেই অলকানন্দা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গম ‘কেশব প্রয়াগ’। বেশির ভাগই এই স্থান দর্শনের পর ফিরে যান। তাই ভীমপুল পর্যন্ত একটু ভিড় চোখে পড়ে।

ভীমপুলকে পেছনে ফেলে অলকানন্দাকে ডান হাতে রেখে যতই সামনের দিকে এগোতে থাকি, ততই ছোট হতে থাকে মানা গ্রামের ঘরবাড়ি। কমতে থাকে লোকজনের উপস্থিতি। আর ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে দিগন্ত বিস্তৃত সুউচ্চ হিমালয় পর্বতরাশি, যার প্রায় সবটাই বরফ-চাদরে মোড়া। কোথাও বা বরফহীন রুক্ষ্ম খয়েরি পাথরের অযত্নের খাড়া দেওয়াল। কোথাও পাহাড় চিরে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদী আর পায়ের নীচের সংকীর্ণ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ি এবড়ো খেবড়ো পথ।

অক্সিজেনের অভাবও বেশ মালুম হয় এ পথে। পাহাড়ের মনও এখানে ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কখনও রোদের জ্বালাতনে কাহিল হয়ে যেই না জ্যাকেট খুলে একটু হালকা হওয়া, অমনি কোথা থেকে শোঁ-শোঁ শব্দে হাজির হয় শীত পাহাড়ের হাড় কাঁপানো হিমেল হওয়া। কোনও রকমে বাবাগো-মাগো বলে কাঁপতে কাঁপতে আবার সব কিছু গায়ে চাপিয়ে নিস্তার পাওয়া।

‘মাথার ওপরের আকাশে মেঘ দেখেছি।
ঝড় তুফানের প্রতিকূলতা দেখেছি,
আবার ফাল্গুনের সমীরণে মন ভিজিয়েছি,
নদী ঝর্ণায় গান খুঁজে পেয়েছি…
চলা তবু থামেনি…’

একেবারে থামেনি বলাটা মিথ্যে হবে। কখনও কাজু-কিসমিসের ব্রেক, তো কখনও ফোটোগ্রাফির ব্রেক। আর এই অজুহাতে বেশ কিছুটা সময় একটু জিরিয়ে নেওয়া। যাই হোক, এই ভাবে চলতে চলতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলাম, কিন্তু কোথায় সে? কোথায় তার ঘর?

একটু যে তার খবর নেব, সে উপায়ও নেই। কারণ, এ পথে ফিরতি কাউকে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। অগ্যতা সামনের দিকে চলতে থাকা শুধু তাকে দেখার আশায়। হঠাৎই দেখি রাস্তা শেষ, সামনে এক বিশাল পাহাড়ি জলধারা বয়ে চলেছে নিজের ছন্দে।

আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, ‘ওহ্! অ্যাট লাস্ট! বসুধারা।’ কিন্তু পর মুহূর্তেই ভুল ভাঙল। এখানে তো কোনও বরফ নেই… রাস্তাও তো শেষ। তা হলে কি ভুল পথে এলাম!

সঙ্গী গাইড রাহুল বলে উঠলেন, ‘ম্যাডামজি, কেয়া হুয়া? আগে চলিয়ে।’

কী বলে ছেলেটা! পাগল নাকি? আগে তো রাস্তা বলে আর কিছুই নেই! যাবটা কোথায়! বললাম, ‘‘উই ডিড এ মিসটেক। ইটস আ রং রুট!’’

ও হাসতে হাসতে কিছু না বলে বড় বড় পাথর ডিঙিয়ে ঝর্নাটাকে এক পলকে পার করে চলে গেল একদম তার পেছনে। ওর কাণ্ড দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! ওরে বাবা! এই ঠান্ডায়, এত জলে! যদি ভিজে যাই! যেমনটা ভাবনা, ঠিক তেমনটি কাজ। ঝ্প করে একটা পা পড়ল ওই ঠান্ডা জলে। আর জুতো বাবাজি তো ভিজে একেবারে স্যাপ-স্যাপে। যাই হোক, ঝর্নাটাকে পার করে আবার চলতে থাকা! এ যাত্রায় রাহুল রক্ষা করল, না হলে তো পরিশ্রান্ত মন এই ঝর্নাটাকেই বসুধারা মেনে নিয়ে ফেরার পথ ধরত।

টেহরি ড্যামের নীচে ঘুমিয়ে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষের মৃত স্বপ্ন

আরও দু’কিলোমিটার হাঁটার পরে দেখা পেলাম সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত আমার ‘বরফ পাহাড় ঝর্নার’… এক বারও না দেখে শুধু শুনে শুনেই ভালবেসেছি যাকে, সেই বসুধারার। দুধ সাদা তার রং, বরফের আদরে মোড়া, একাকী, নিঃসঙ্গ। তার যেটুকু জল ঝর্না হয়ে ঝরছে, তা-ও আবার ওই জমে থাকা কঠিন বরফের সংস্পর্শে এসে তুষার হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই।

বহমান জলের ধারা জমে বর্শার ছুঁচোল ফলার মতো ঝুলে আছে নীচের দিকে… যেন কেউ মন্ত্রবলে তাদের থামিয়ে দিয়েছে চিরতরে। তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে মাঝে মাঝে গুম-গুম শব্দে অনেক উঁচু থেকে ভেঙে পড়ছে শক্ত তুষার চাঁই। চার দিকে এক অদ্ভুত প্রশান্তির নিস্তব্ধতা… যাকে বর্ণনা করার ধৃষ্টতা আমার লেখনীর নেই। এখানে সব কিছুই যেন অনন্ত… চিরন্তন… শাশ্বত

ইস্… যদি সারা জীবন থেকে যেতে পারতাম! কত ক্ষণের জন্য যে বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম তা মনে নেই! হুঁশ ফিরল রাহুলের ডাকে, ‘ম্যাডামজি, অনেস্টি কা এক্সাম টাইম আ গয়ে!’

ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালাম। ভিজলাম তার পবিত্র ধারায়। করজোড়ে প্রার্থনা করলাম, যদি নিজের অজান্তে কোনও পাপ করে থাকি, ক্ষমা করে দিও হে পবিত্র জলরাশি।

দু’চোখ ভরে দেখলাম আর স্মৃতিপটে সযত্নে আঁকলাম তার ছবি। মনে মনে বললাম, ‘তোমায় না দেখে, না জেনেও যে ভালবেসেছি, তাতে কোনও ভুল করিনি।’

কেটে গেল বেশ কিছু সময়। আর ঘড়ির কাঁটা জানান দিল, ফিরে যেতে হবে।

সত্যিই তো, ফিরে যেতে হয়।

যাদের ফেলে এসেছি তাদের কাছে… সেই পা ভিজিয়ে দেওয়া ঝর্না, সেই বড় বড় বোল্ডারের পথ, পথের দু’ধারের ঘাস ফুল। সেই পথেই তো এ বার ফেরার পালা।

ছোট হয়ে আসা সেই গ্রামটার কাছে পৌঁছতে হবে। পৌঁছতে হবে মানার সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে আমাদের অপেক্ষায় থাকা প্রিয় মানুষটার কাছে…
‘চলা তাই থামেনি।

‘চলতে চলতে কত দূর যে চলে আসা হল
শহুরে ভিড়। ট্রাম বাসের তীক্ষ্ণ চিৎকার
মানুষজনের স্লোগান, ভাষণ হৈ চৈ পরচর্চা
এমন তর কত যে হাবি-যাবি
পেয়েছি… হারিয়েছি!’

একবার ঘুরে দেখলাম। নাহ্, তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। দূর থেকে আরও দূরের হয়ে হারিয়ে গেল আমার সেই বরফ পাহাড়ের ঝর্না।

বুক বাঁধি নতুন আশায়। ‘ফিরে যেতে হয়, যাকে ভালবাসি তার কাছে… আবার’।

কবিতা সৌজন্য: শুভ দাশগুপ্ত।

টেহরি ড্যামের নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষের মৃত স্বপ্ন