লামাহাটায় হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় চূড়ায় মেঘের সঙ্গে দেখা

লামাহাটায় হাঁটতে হাঁটতে

মেঘ বালিকা


লামাহাটায় হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে দেখা পেলাম শান্ত শীতল এক জলাশয়ের। যার শরীরে ছায়া ফেলে প্রকৃতি। তার উপর দিয়ে পত পত করে উড়ছে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। লেকের পাড়ের নিস্তব্ধতা হঠাৎই কড়ও ভেঙে দিচ্ছে কোনও নাম না জানা পাখি। একপাস থেকে অন্য পাশে তার উড়ে যাওয়ার ডানার শব্দ আসতে আসতে মিলিয়ে যায় কোন অতলে। ওই লেকের পাড় মন শান্ত করে দেয়।

তখন উপর থেকে ঝুপুৎ করে নেমে আসে একদল মেঘ। দু’পা দুরে দাড়িয়ে থাকা নিজের সঙ্গিকেও তখন দেখা যায় না। সেই মেঘ আমাদের ছুঁয়ে চলে যায় কোনও অনন্তের খোঁজে। অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে একদল স্থানীয় ছেলে-মেয়ের কলতান। ওরাও এসেছে এই নিস্তব্ধ প্রকৃতির কাছে। জঙ্গল ভেদ করে ওরা হারিয়ে যায় কোন গভীরে। আমরা ফেরার পথ ধরি। মেঘ ছোয়ায় ভিজে যায় গা। ছাতা খুলতে ইচ্ছে করে না। বৃষ্টি নাকি? হোক তবে।

সে দিন সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছিলাম দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। পথে দেখা লামাহাটার সঙ্গে। যখন প্রথম এখানে ট্যুরিজম শুরু হয়েছিল তখন এসেছি‌লাম। সে দিনও এই পাহাড় চড়ে পৌঁছেছিলাম ওই লেকের পাড়ে। তার পর কেটে গিয়েছে ৬ বছর। লামাহাটার তেমন বদল হয়নি। পার্কে ঢুকতে এখন শুধু ১০টাকার টিকিট কাটতে হয়। সেই টিকিট কেটে শুরু পাথরের তৈরি সিঁড়ি ভেঙে উঠে চলা। কখনও সখনও একটু আধটু শর্টকাট। পুরোটাই চড়াই। হাফ ধরে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে দেখা হয়ে যায় স্থানীয় প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে। হাসি মুখে ওরাই আমাদের রাস্তা দেখায়। সাবধান করে বলে, অনেকটা রাস্তা, পারবেন তো। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে যান। ওরাই ভরসা দেয়। আমরাও উঠে চলি।

পাইনের ঘন বন ক্রমশ ঘন হয়। সঙ্গে হারিয়ে যায় সূর্যের আলো।  মেঘের দখলে যে তখন গোটা চরাচর। পথের মাঝে মাঝে বিশ্রামের জায়গা রয়েছে। চাইলে বসে জিড়িয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু মন পড়ে যায় সান্দাকফু ট্রেকিংয়ের সময় আমাদের গাইড বলেছিলেন, ‘‘কখনও ট্রেক করতে করতে দুম করে বসে পড়বেন না। তা হলেই পায়ে ক্র্যাম্প হয়ে যাবে। দাড়িয়ে বিশ্রাম নেবেন। সেই থেকে আজও সেটাই মেনে চলি। সঙ্গিকেও তাই বলি। দাড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চলি। নিয়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসে লামাহাটার জনপদ।

গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট ঘর। হোম স্টে। না আমরা এ যাত্রায় লামাহাটায় থাকব না। দেখে চলে যাব দার্জিলিং। পথের ক্লান্তি যখন জাঁকিয়ে বসেছে তখনই গাছের গায়ে সেই বোর্ড দেখে স্বস্তি পাই। পৌঁছে গিয়েছি সেই লেকের সামনে। স্থানীয় লোককথায় আছে, প্রাচীন কালে নাকি এই পাহাড়ের উপর দুটো জলাশয় ছিল। কিন্তু কালের নিয়মে তা বন্ধ হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জায়গাকে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে রূপ দেওয়ার পর সেই লেক দুটোকে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় লেকের দেখা পেলাম না। তা আবার ঢেকে গিয়েছে জঙ্গলে।

মেঘ-বৃষ্টির মধ্যেই ফেরার পথ ধরলাম। পথে দেখা হয়ে গেল এক যুগলের সঙ্গে। স্ত্রীর জন্মদিন পালন করতে এসেছে স্বপরিবারে। মনে মনে প্রার্থণা করি ওরা এমনই সুখে থাকুক। শহুরে হাওয়া যেন ওদের স্পর্শও না করে। মনটা পাহাড়ের মতই বড় থাকুক, স্নিগ্ধ থাকুক। বেঁচে থাকু এই নির্মল হাসি। ফেরাটা খুব দ্রুত হল। স্থানীয় দোকানে কফি খেয়ে লামাহাটাকে বিদায় জানালাম। মনে মনে বললাম ভাগ্যিস পাহাড়ের মাথায় ফোনের নেটওয়ার্ক ছিল না। না হলে যে টেকনোলজি গ্রাস করে ফেলত এই পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ভাললাগাকেও।

রাবাংলা পৌঁছে দেখি সব হোটেল বন্ধ করে সমতলে নেমে গিয়েছে