দার্জিলিং আর আমি, আর আমার একলা বাঁচার অভ্যেস

দার্জিলিং আর আমি

দার্জিলিং আর আমি একটা দারুণ অনুভূতি। জীবনের সব রাস্তা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন একটিই রাস্তা খোলা থাকে। একটু সাহস করে সেই পথে হাঁটতে পারলেই মনের মুক্তি। জটিলতাগুলো কাটিয়ে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ফিরে পাওয়া যায়।  আর কার কী হয় আমি জানি না আমার তো হয়। সময়ের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার শক্তি আমাকে জোগায় পাহাড়। ট্যাকে টাকা নেই, ভবিষ্যতের নিশ্চিন্ত ঠিকানা নেই, মাস গেলে হাতে মোটা মাইনে নেই—তবুও কিছু একটা আছে। আর যেটা আছে সেটা যে অনেকের কাছে নেই। লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


না আর ভনিতা না করে বেড়ানোটাই শুরু করে দিই। কোভিড থেকে দেশ তখন কিছুটা হলেও মুক্ত। মানুষ আতঙ্কের আবহ থেকে বেরিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমিও বা পিছিয়ে থাকি কী করে। বেরিয়ে পড়লাম লোটা কম্বল নিয়ে। কার্যত লোটা কম্বল নিয়েই বেরতে হল। কারণ ট্রেনে বিছানা দিচ্ছে না। এসি কামরায় চাদর কম্বল ছাড়া সম্ভব নয়। ডিসেম্বর মাস হওয়ায় কোনও কামরাতেই তা সম্ভব ছিল না। তাই জামা-কাপরের সঙ্গে থাকল বিছানাও।

দার্জিলিং মেলের টিকিট কেটে রওনা দিলাম আমার ভালবাসার বারান্দার পথে। সঠিক সময়েই ট্রেন আমাকে নামিয়ে দিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে থেকে গ্যাংটকগামী গাড়িতে চেপে নেমে পড়লাম তিস্তা বাজারে। সেখানেই অপেক্ষা করছিল বরামাঙ্গওয়া ফার্ম হাউস থেকে পাঠানো গাড়ি। মিনিট ৪০ এর সেই চির চেনা পথের যাত্রা আমাকে পৌঁছে দিল আমার প্রিয় পাহাড়ি গ্রাম বরামাঙ্গওয়ায়। তবে আজ বরামাঙ্গওয়ার কথা বলব না বলব সবার প্রিয় দার্জিলিংয়ের কথা।

এই পাহাড়ি গ্রামে দু’দিন কাটিয়ে চলে গেলাম দার্জিলিং। হাতে তখনও চারদিন। প্রিয় দার্জিলিংয়েই কাটাবো বাকি সময়টা আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম। পেয়ে গেলাম প্রিয় হোটেলও। ব্যস আমাকে আর পায় কে। ডিসেম্বরের শেষ, বুঝতেই পারছেন তাপমাত্রার পাদর কোথায় নামতে পারে। সারাদিন কনকনে ঠান্ডা। নতুন বছরের আহ্বানে ম্যালে তৈরি হয়েছে মঞ্চ। প্রায় সারাদিনই চলছে অনুষ্ঠান। কিন্তু আমার প্রিয় তো ম্যালের পিছনের রাস্তা আর মহাকাল মন্দিরের ওই ভেজা ভেজা পথ।

প্রথম দিনটি অবশ্য কেটে গেল গ্লিনারিজে খেয়ে আর ঘুমিয়ে। জানলায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে মানুষের ঢল। তাই খুব বেশি না বেরিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। পর দিন সকাল হল বেশ দেরিতেই। কোনও তাড়া নেই, সাইড সিন করার মতো বিচ্ছিরি রুটিন নেই, তাই হেলতে-দুলতে পৌঁছে গেলাম ম্যালের পাসের মার্কেট টপকে সেই চিরকালীন প্রিয় রাস্তায়।

গত কয়েকমাস ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিনই দেখছিলাম শিলিগুড়ি, ধুপগুড়ি, আলিপুরদুয়ারসহ উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জায়গা থেকেই দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দূষণ কমে গিয়েছে লক-ডাউনের জন্য। মানুষ কম বেরচ্ছে রাস্তায়। সব মিলে প্রকৃতিও হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। ওই রাস্তায় পা দিতেই টের পেলাম এতদিন যা দেখছিলাম তা সব সত্যি ছিল। ডান প্রান্ত ধরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তুষারশৃঙ্গ।

সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতেই রাস্তার ধারের বেঞ্চে বসে স্থানীয় লোকের বানিয়ে দেওয়া কফি আর ম্যাগি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে হাঁটা লাগালাম মহাকাল মন্দিরের দিকে। আমার ঠাকুরে কোনও বিশ্বাস নেই কিন্তু এই মহাকাল মন্দির চত্তরটা আমার খুব পছন্দের। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। ততক্ষণে মাঝ দুপুরে পৌঁছে গিয়েছে সময়ের কাটা। ছুঁচোও ডন দিচ্ছে পেটে। এত হাঁটার ফল। কিন্তু হোটেলে ঢোকার সময়ই চোখে পড়েছিল গ্লিনারিজের সামনের সেই বিরাট লাইন। তাই ও পথে আর পা বাড়ানো যাবে না আগেই বুঝে গিয়েছিলাম।

প্রথম দিনই হোটেলের বাচ্চা ছেলেটির ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। খুব মিষ্টি। হোটেলে রেস্টুরেন্ট বন্ধ ছিল। তাই ওকেই জিজ্ঞেস করলাম খাওয়ার কী করব? ও আমতা আমতা করে জানাল, ওরা নিজেদের খাওয়ার জন্য ভাত, ডাল, ভাজি আর সবজি বানাবো। কিন্তু আমি খাব কিনা তা আর সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারছে না বুঝতে পেরে আমি নিজেই জানতে চাইলাম আমার তাতে ভাগ জুটবে কিনা। ওটা শুনে ও রীতিমতো খুশি হয়ে চলে গেল। তার পর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই ওদের খাওয়াতেই ভাগ বসিয়েছি।

এই ক’দিন দার্জিলিংয়ের সব বিকেলই শুরু হত কারও না কারও গান দিয়ে। ম্যালের মঞ্চে পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমার গানেই নতুন বছরকে স্বাগত জানালাম চারদিকে ভিড় করে থাকা অচেনা মানুষদের সঙ্গে। বিশ্বাস করুন এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে একা লাগেনি। বরং মনে হয়েছে, এই বেঁচে থাকাটাই আসল।

সারাদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা, কনকনে ঠান্ডা, প্রচুর মানুষের ভিড় নিয়ে দারুণ কেটেছিল চারটে দিন। মাঝে এক স্থানীয় বন্ধুর কাছে আবদার করেছিলাম চিলি পর্ক খাওয়ার। সে আমাকে দার্জিলিংয়ের এক পুরনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। ম্যালের নিচের রাস্তায় এর আগে এতবার এসেছি কখনও যাইনি। এবার ওই রাস্তায় গিয়ে দেখলাম দারুণ সব থাকার জায়গা, রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যেখানের ছাদে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে কফি খাওয়া মনে থাকবে সারাজীবন।

আরও অনেক স্মৃতি নিয়ে সারাজীবন থাকবে এই দার্জিলিং সফর। কতবার দার্জিলিং গিয়েছি গুনিনি। আরও কতবার যাব জানি না। তবে, কোভিডের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একা একা দার্জিলিংয়ে কাটিয়ে দেওয়ার দিনগুলোর অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম।

ছবি: সুচরিতা সেন চৌধুরী

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)