বেতলার অরণ্যে দিন থেকে রাত হল, মনে থেকে গেল বন্যপ্রাণের নিস্তব্ধ চলাচল

বেতলার অরণ্যেবেতলার অরণ্যে হরিণের পাল

মেঘ বালিকা


পুজো আসছে আসছে করতে করতেই কখন যেন এসে আবার চলেও যায়। রেখে যায় এক বছরের অপেক্ষা। তাই পুজোর অনেক আগে থেকে বাঙালি মেতে ওঠে পুজো পালনে। সে শপিং হোক বা বেড়ানো। তিন-চার মাস আগে থেকেই সাজ সাজ রব। বেড়াতে গেলে ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে তিন মাস আগে। তাই পরিকল্পনাও সেরে ফেলতে হবে তারও আগে। একটা সময় ছিল পুজোর চার দিন শহরেই থাকতাম। যদিও প্যান্ডাল হোপিংয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। ঘরে বসেই কেটে যেত ওই দিনগুলো। তাই একটু বদল করে ওই সময়ই আজকাল বেরিয়ে পড়ি ঘুরতে।

গত বছর পুজো অনেকটাই আগে ছিল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। সাধারণত পুজো মানে লম্বা ট্যুরের পরিকল্পনাই হয়। কিন্তু এ বার হাতে সময় কম ছিল। তাই কাছে পিঠে কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে পড়ল পালামুর নাম। জঙ্গল খুব একটা আমাদের যাওয়া হয় না। কিন্তু পর পর দু’বছর জঙ্গল হয়ে গেল। এর আগের বার গিয়েছিলাম করবেট ন্যাশনাল পার্কে। আর এ বার পালামুর জঙ্গলে

সঙ্গে আরও অনেক কিছু থাকলেও আজ শুধু জঙ্গলের কথাই বলব। এই পুরো ট্যুরে জঙ্গলটাই মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে কেউ বলেনি খুব ভাল। সবাই বলেছিল ওই জঙ্গলে কিছু নেই। পুরো ন্যাড়া। গাছ কেটে ফেলেছে ইত্যাদি। কিন্তু এই জঙ্গলই আমাদের উজাড় করে দিয়েছিল।

কলকতা থেকে অষ্টমীর রাতে ট্রেন ধরে নবমীর সকালে পৌঁছে গিয়েছিলাম রাঁচী। ওখানে পুজোর তেমন কোনো আতিসজ্য নেই। বেশ কয়েকটি মোরে পুজো হচ্ছে অবশ্য়। সেদিন রাচি দেখে পর দিনই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম বেতলার উদ্দেশে। রাঁচী থেকে ১৭০ কিলোমিটার। ১৯৭৪ সালে এই টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট স্বীকৃতি পায়। প্রথথমে ন’টি বাঘ ছিল। ১১২৯ কিলোমিটারের থেকে কিছুটা বেশি অংশ জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে এই জঙ্গল। তার মধ্যে কোর এরিয়া ৪১৪ কিলোমিটারের কিছু বেশি আর বাফার এরিয়া ৭১৫ কিলোমিটারের মতো।

আমাদের গন্তব্য জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক

এই সব হিসেব আসলে ঘোরার সময় কোনও কাজে লাগে না। ওটা ভীষনভাবে মনের। দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বেতলা। হোটেল ঠিক করাই ছিল। সকলেই স্নান সেরে চলে গেলাম হোটেলের রেস্টুরেন্টে। লাঞ্চ হতেই ডাক এল সাফারির। বিকেলে সাফারির করা পরিকল্পনা করাই ছিল। কলকাতা থেকে ফৈয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলন আমার এক বন্ধু। জঙ্গলের সামনে পৌঁছে দেখলাম গাড়ি নিয়ে তৈরি ফৈয়াজের মামা। ফৈয়াজ পাশেপাশে অন্য ট্যুরিস্ট নিয়ে। মূল গেট পেরিয়ে গাড়ি জঙ্গলে ঢুকতেই আবহটা বদলে গেল। উধাও দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিও। চারদিক খোলা জিপে আমরা ছ’জন।

জঙ্গল ঘন থেকে ঘন হল। কোথাও কানে ভেসে এল জঙ্গলের ভিতর থেকে হাতির ডাক। কোথাও আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল লাল লাল চোখ। গাড়ি থামিয়ে চুপটি করে বসে থাকলাম। বাঁ দিকে ঘন জঙ্গল আর জান দিকে খোলা জায়গায় একটা ছোট্ট জলাশয়। সেই ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে শূর উঁচিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। তাঁকে দুলকি চালেই যখন আমরা মুদ্ধ তখন সবাই কে চমকে দিয়ে পর পর বেরিয়ে এল ছোট, বড়, মেজরা। ড্রাইভার বললেন, ‘পুরো পরিবার নিয়ে ওরা জল খেতে বেরিয়েছে। রাস্তা পেরিয়ে জলাশয়ে নেমে পড়ল হাতির দল। সব থেকে ছোট্টটাকে নিজের শূরে করে জলে নামাল পরিবারের মুখিয়া। মন ভরে দেখলাম সেই দৃশ্য়। এত কাছ থেকে বন্য হাতি এর আগে দেখিনি।

ওদের পিছনে ফেলে আবার চলার শুরু। কিছু দূর যাওয়ার পরই রাস্তার দু’ধারে দেখা হয়ে গেল বাইসনজুটির সঙ্গে। মন দিয়ে ঘাসপাতা খেতে খেতেই আমাদের মেপে নিল একবার। ড্রাইভার বললেন, ‘ওরা বিরক্ত হচ্ছে। এগিয়ে যাওয়াই ভাল। না হলে অ্যাটাক করতে পারে।’ আমরাও এগোলাম। চলতে চলতে দেখা হয়ে গেল বুনো শুয়োর, ময়ুর, হরিন, প্যাঁচাদের সঙ্গে। সার দিয়ে গাছ থেকে ঝুলতে থাককা বাবুই পাখির বাসা দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। এ ভাবে একটা জঙ্গলল সব উজাড় করে দিতে পারে? যা আমাদের দিল বেতলা।

চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যেই অন্ধকার নামল। ফিরতে হবে বললেন ড্রাইভার। আমাদের না পাওয়া কিছু নেই। তাই সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি জানালাম। এতক্ষণ বন্য প্রাণের খোঁজে চোখ ঘুরছিল এদিক ওদিক। এ বার শুধু জঙ্গলকে উপভোগ করা পালা। রাতের অন্ধকারে শুধু গাড়ির হেট লাইটের আলোয় জঙ্গল ছেড়ে মানুষের জগতে ফেরা। মনটা যেন থেকে গেল ওই হাতির পরিবারের সঙ্গেই। ওরা হয়ত এতক্ষণে ফিরে গিয়েছে নিজের ঘরে। আমরাও ফিরলাম। এই ট্যুরের তালিকায় অনেক কিছু থাকলেও শুধু মনে থেকে গিয়েছে বেতলা, বেতলার জঙ্গল, বন্য প্রাণ। এ বলেছে বেতলায় কিছু নেই? যা আছে তা অনেকের নেই।