বেড়ানোর নেশা সঙ্গে করে পায়ে পায়ে বরফ ডিঙিয়ে ভার্সে

বেড়ানোর নেশা

বেড়ানোর নেশা কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না। যে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা যায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। যে বেড়ানোর স্মৃতি, প্ল্যান, ছবি—সব অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে। সেই বেড়ানোই আসলে জীবনের রিফ্রেশ বোতাম। ক্লান্তি, গ্লানি, যন্ত্রণা, অশান্তি সব কিছু এক লহমায় বদলে দিতে পারে বেড়ানো। হোক না সেটা বাড়ির পাশের পুকুরের ধার বা একটু এগিয়ে গঙ্গার ঘাট। ওই যে স্কুলের পাশের হালকা জঙ্গল জঙ্গল পরিবেশটা যেখানে তির তিরে হাওয়া খেলে যায় সব সময়, সেটাও হতে পারে। তার সঙ্গে ট্রেনে বা বিমানে চেপে দূর দেশে পাড়ি দিতে পারলে তো কথাই নেই। না পারলে এই সই। পায়ে পায়ে কখনও পাহাড় তো কখনও সমুদ্র, জঙ্গল, মরুভূমি। হাত বাড়ালেই টের পাওয়া যায় এই দেশ উজাড় করে দিয়েছে প্রকৃতিকে। এবার পায়ে পায়ে কোথায় পৌঁছলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


আজ বলব বার্সে বা ভার্সের কথা। ছোট্ট চার কিলোমিটারের ট্রেকিং। যাতায়াত নিয়ে আট কিলোমিটার।

শীত শেষের বৃষ্টি মানেই মনটা উড়ু উড়ু৷ পাহাড় এমনিতে সব সময়ই ডাকে৷ তিনি আমাকে ডাকতে ক্লান্ত হন না৷ কিন্তু এ রকম কলকাতা শহরে পাহাড়ি আবহাওয়া দেখলেই কেমন যেন মন আর কাজে বসে না৷ হারিয়ে যাওয়া শীত যাওয়ার আগে ডেকে বলে যায় আবার আসব আগামী বছর৷ ততদিন ভাল থেকো, আমার অপেক্ষায় থেকো৷ কলকাতার মানুষ কী ভাবে যে শীতের অপেক্ষায় থাকে সে তো শীত জানে৷ তাই হয়তো আকাশের মুখও ভার৷ বিদায় নিচ্ছে শীত৷ যাওয়ার পথে কলকাতাকে ভিজিয়ে, সিকিমে, সিমলায় বরফ বৃষ্টির ছোয়ায় একটা ছোট্ট শীতের কামড়৷ এরকমই এক শীত শেষের বর্ষায় পৌঁছে গিয়েছিলাম পশ্চিম সিকিমের ভার্সেতে৷ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে পেলিং পৌঁছতে রাত গড়িয়ে গেল৷ রাস্তায় বৃষ্টি মাঝে মাঝেই পথ আটকালো৷

বরফের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল রডোডেনড্রন (বাঁদিকে) ভার্সের একমাত্র থাকার জায়গা (ডানদিকে)

পেলিংয়ে রাত্রি যাপনের পরদিনই ছুটলাম ভার্সের পথে৷ পরদিন থেকে আকাশ পরিষ্কার৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে পেলিংয়ের আনাচ-কানাচ দিয়ে৷ জানলার কাচে বৃষ্টির জল লেগে রয়েছে তখনও৷ কনকনে ঠান্ডায় লেপের তলা থেকে বেড়নোই দায়৷ কিন্তু গন্তব্য তো আরও অনেক দূর৷ মাঝে রাত্রিবাস সোমবারিয়াতে৷ ছোট্ট গ্রামে কাঠের গেস্ট হাউস৷ স্থানীয় মানুষদের অসাধারণ আতিথেয়তা সঙ্গে গরম গরম মুরগির ঝোল আর ভাত৷ পরদিন সকালে উঠেই ভার্সের পথে ট্রেকিং শুরু৷ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চার কিলোমিটার রাস্তা৷ এক কথায় রাস্তা বলে কিছুই নেই৷ স্থানীয় মানুষের পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া সরু রাস্তা৷

সোমবারিয়ায় লেপের নীচে উষ্ণতার খোঁজে গা এলিয়ে দেওয়ার আগের আকাশ জানান দিল মেঘ করেছে, খবর এল দূরে কোথাও দু’এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে৷ বৃষ্টিতে ট্রেকিং হবে না এটা নিশ্চিত৷ প্রকৃতি দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে করতেই ঘুমের দেশে পৌঁছে গেলাম৷ সকালে ঘুম ভাঙল ড্রাইভারের ডাকে৷ গাড়িতে যেতে হবে হিলে পর্যন্ত৷ তার পর শুরু হাঁটা৷

রাতে চোখে পড়েনি, ভোরেই আমাদের দু’বাহু বাড়িয়ে সুপ্রভাত জানাল রডোডেনড্রন৷ স্থানীয় ভাষায় গুরাস৷ লাল টকটকে গুরাসের আহ্বানকে বিদায় জানিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম হিলের পথে৷ বৃষ্টি নেই, আকাশ পরিষ্কার, ঠান্ডাও বেশ কম৷ হিলের যেখানে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম সেখান থেকে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের ধাপ কাটা সিঁড়ি৷ উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠেই শুরু হয়ে গেল ঘন জঙ্গল৷ আর পাহাড়ের গা দিয়ে একজন মানুষের হাঁটার মতো সরু রাস্তা৷

নিস্তব্ধ জঙ্গলে আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল৷ কখনও শুকনো পাতায় পা পড়লে সব নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান৷ কখনও হালকা হাওয়ায় খসে পড়ল একগুচ্ছ পাতা৷ আমাদের সঙ্গে আসা গাড়ির ড্রাইভার বলল, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে তো তাই৷ পায়ের তলার মাটিও বেশ ভিজে৷ চলতে চলতেই আকাশ কালো করে এল৷ সূর্যের আলো না ঢোকা জঙ্গলে ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার৷ টিপটিপ বৃষ্টি ছুঁয়েই চলে গেল অন্য কোথাও৷ পথ এগিয়ে চলল নিজের ছন্দে৷ কোথাও কোথাও খুব পিচ্ছিল৷ ঝড়ে গাছ ভেঙে রাস্তা বন্ধ৷ সেই গাছের ফোকর গলে এগিয়ে যাওয়া৷ তখনও জানি না সামনে কী অপেক্ষা করে রয়েছে৷

এভাবেই বরফে মোরা ছিল হিলে থেকে ভার্সে পুরো রাস্তা

ঠিক এতটাও আশা করিনি৷ ভাবিনি প্রকৃতি এভাবে উজাড় করে দেবে তার ঐশ্বর্যকে৷ যে দিকেই তাকাচ্ছি শুধু বরফ আর বরফ৷ এমনটা তো হওয়ারই কথা নয়৷ এই সময় বরফ? ড্রাইভার বলল, কাল রাতে হয়েছে মনে হচ্ছে৷ এবার হাঁটা শুরু বরফের রাস্তা ধরে৷ পা দিলেই সরে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে বরফ৷ গাছের পাতার গা থেকে খসে পড়ছে বরফের কুচি৷ যত এগোচ্ছি বরফের আধিক্য বাড়ছে৷ নিচে যতদূর খাদ দেখা যাচ্ছে শুধুই বরফ, গাছের সবুজ ঢেকে দিয়েছে সাদা বরফ৷ উফ, এত বরফ একসঙ্গে কখনও দেখিনি আমরা৷ তবে, বরফের উপর দিয়ে পথ চলা কিছুটা মন্থর হয়ে গেল৷ প্রতিটি স্টেপেই পা পিছলে যাচ্ছে৷

শেষ পর্যন্ত গাছের ডাল ভেঙে লাঠি বানিয়ে তাকেই ভরসা করে চলতে হল৷ এভাবেই বরফের রাস্তা পেড়িয়ে পৌঁছে গেলাম ভার্সে৷ সেখানেও ছড়িয়ে রয়েছে বরফ৷ জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বরফ মোড়া শৃঙ্গ। রাতের অন্ধকারে এখানে নাকি বেড়িয়ে আসে বন্য প্রাণীরা৷ রেড পন্ডা আছে। তাই ফেরার পথ ধরতে হবে৷ পৌঁছতে হবে অন্ধকার নামার আগেই৷ ভার্সের উপরে একটাই থাকার জায়গা৷ সেখানেই কিছুক্ষণের বিশ্রাম গরম গরম কফি আর মুড়ি-চানাচুর সহযোগে টিফিনটাও দারুণ জমে গেল৷ তার পর আবার চলার শুরু৷ একই পথে, একই গন্তব্যে৷

বরফে হাঁটা বেশ কঠিন বার বার পিছলে যাওয়ার ভয় থাকে

বরফের রাস্তা, জঙ্গলের নিঃস্তব্ধতা, পাতার খসখস শব্দে চমকে দেওয়াকে পিছনে ফেলে ফিরে চলা সোমবারিয়ার পথে৷ পথে দেখা হয়ে গেল পথ চলতি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে৷ তাঁরাও হেসে বিদায় জানালেন৷ ভার্সেকে বিদায় জানালাম আবার ফিরে আসার একরাশ ইচ্ছে নিয়ে৷ ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা রাত কাটানোর অদম্য ইচ্ছে নিয়ে৷ সেই রাতে বৃষ্টি এল ঝাঁপিয়ে৷ যতক্ষণ জেগেছিলাম টিনের ছাদে বৃষ্টির আস্ফালন শুনেছি৷ সকালে স্থানীয় মানুষরা জানালেন আজ বরফে ঢেকে গিয়েছে ভার্সে৷

ছবি—সুচরিতা সেন চৌধুরী

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)