রিকিসুম, নিস্তব্ধ জঙ্গলে ভালবাসার উপন্যাস লিখে চলে প্রতিদিন

রিকিসুম

রিকিসুম নামটা খুব পরিচিত নয় ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে। আসলে রাস্তার উপর ছোট্ট একটা জনপদ। সেটাকে কাটিয়েই সবাই এদিক ওদিক চলে যায়। তেমনভাবে নজরে আসে না। পরিকল্পনা না করে ঘোরার মজাটা যে কী সেটা সে ভাবে না ঘুরলে বোঝা মুশকিল। যেখানে মন চায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে থেকে যাও। এভাবেই আবিষ্কার রিকিসুমের, লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


বর্ষায় পাহাড়ে যাব না ভেবেই কলকাতা থেকে দার্জিলিং মেলে চেপেছিলাম আমরা৷ কিন্তু কোথায় কী? মূর্তিতে একদিন থাকার পরেই মনটা কেমন পাহাড় পাহাড় করতে শুরু করল৷ সবারই এক অবস্থা৷ কিন্তু কেউ কাউকে বলছে না৷ সবাই ভাবছে বললে হয়তো অন্যরা ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেবে না৷ একরকম পরিকল্পনা করে আসা৷ রাতারাতি সেটা পরিবর্তন করাটাও মুশকিল৷ কিন্তু আমার সত্যিই ভাল লাগছিল না৷ আসার সময় গাড়ি থেকে দূরে পাহাড়ের হাতছানি দেখেই মনটা কেমন যেন বদলে গেল৷ মূর্তিও খুব একটা কারও যে মনে ধরেছে তেমনটা নয়। সেটা বুঝেই রাতের খাবার খেতে খেতে প্রস্তাবটা দিয়েই ফেললাম৷

বলেই ফেললাম, ‘‘এখানে ভাল লাগছে না৷ পাহাড়ে চল৷ আমরা কবে বর্ষার ভয়ে পাহাড়ে যাইনি? এবারই বা ব্যাতিক্রম হবে কেন?’’ সেকেন্ডের জন্য সব চুপ তার পরই উচ্ছ্বাস৷ সবাই ঘুরে-ফিরে বলতে থাকল, ‘‘আমিও তাই ভাবছিলাম৷’’সেই রাতে মূর্তিতে প্রবল বৃষ্টি এল৷ সারারাত বৃষ্টি হল৷ কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই প্রায় গড়িয়ে গেল মধ্যরাত৷ শেষ পর্যন্ত ঠিক হল মূর্তি থেকে বেড়িয়ে আগে লাভা পর্যন্ত যাওয়া যাক৷ সেখান থেকে কিছু একটা বিকল্প নিশ্চয় বের করা যাবে৷ হাতে তখনও তিনদিন৷ সবাই বেশ খুশি খুশি মনে ঘুমতে গেলাম৷ পরের দিন ভোর হল আকাশের মুখ ভার করেই৷ তবে বৃষ্টিটা নেই৷ মূর্তিকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম লাভার উদ্দেশে৷ গাড়ির ড্রাইভারের কাছেই জানতে পারলাম রিকিসুমের নাম৷

রিকিসুম

মেঘলা রিকিসুম

যেমন বলা তেমনই কাজ৷ লাভা থেকে সেই গাড়ির ড্রাইভারই অন্য গাড়ি ঠিক করে দিল৷ কোথায় থাকব সেটাও বলে দিল৷ আমরা আবার চলতে শুরু করলাম৷ মাঝে লাভায় হালকা ব্রেকফাস্টও সেরে নিলাম৷ লাভায় পৌঁছে যেন সবাই স্বস্তি পেল৷ এটাই তো চাইছিলাম৷ লাভার আকাশেও মেঘের রাজত্ব৷ জুলাই মাসে এ ছাড়া আর কিছু আশাও করা যায় না৷ লাভা ছেড়ে রিকিসুমের পথ ধরতেই শুরু হল বৃষ্টি৷ সামনের রাস্তা প্রায় অদৃশ্য৷ হেডলাইটের আলোতে সামনেটা কোনও রকমে দেখা যাচ্ছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম রিকিসুমে৷

ড্রাইভার হাত দিয়ে আমাদের আস্তানা হিসেবে যেটা দেখাল তা দেখে সবাই মুগ্ধ৷ ছুটে এলেন বাড়ির মালিক৷ আমরাও ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে রাস্তা থেকে সোজা পাহাড়ের গায়ে বেয়ে উঠে যাওয়া সিড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম ঘরের সামনে৷ ঘর লাগোয়া খোলা ছাদ৷ অফ সিজিন হওয়ায় ঘরগুলো খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই৷ তবে সঙ্গে সঙ্গেই সব ব্যবস্থা করে গরম গরম চা নিয়ে হাজির সেই বাড়ির মেয়ে৷

রিকিসুম

রিকিসুমের জঙ্গলে দেখা ফুলের সঙ্গে

দুপুরের খাওয়া সেরে রিকিসুমের জঙ্গলে ঘেরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম শুধুই হেঁটে বেড়াতে৷ মাঝে মাঝেই ছিটে-ফোঁটা বৃষ্টি সঙ্গে নানান নাম না জানা পাখির কলকাকলি৷ ফুরুৎ করে সামনে দিয়ে উড়ে গেল নাম না জানা রঙিন এক ঝুটি ওয়ালা পাখি৷ না ক্যামেরায় ধরা গেল না৷ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা পাঁকা থেকে কখন যে কাঁচা হয়েছে খেয়ালই করিনি৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেকটা গভীরে পৌঁছে গিয়েছি ততক্ষণে৷ অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে ফেলে আসা রাস্তা৷ মাঝে মাঝে এক-দুটো গাড়ির আনা-গোনা৷ গাছের পাতা থেকে হাওয়ার দাপটে খসে পরছে জলের ফোটা৷

এমনিতেই মেঘলা আকাশ তার উপর ঘন জঙ্গল কখন যে অন্ধকার নেমেছে টেরই পাইনি। এই অঞ্চলে ট্যুরিস্ট বলতে তখন আমরা ক’জন। অফ সিজিনে ঘোরার মজাই এটা৷ সন্ধের আকাশে আবার বজ্র বিদ্যুতের আভাস পেতেই ফেরার পথ ধরলাম৷ ফিরতে ফিরতেই বৃষ্টি এল। সবাই ভিজলাম৷ জাঁকিয়ে ধরল ঠান্ডা৷ জামা-কাপড় বদলে গরম চাদর মুড়ি দিয়ে গরম গরম চা আর পাকোরা খেতে খেতে অন্ধকারে বৃষ্টি উপভোগ করলাম যতক্ষণ না রাতের খাওয়ার ডাক এল৷ সোলারের আলো তখন নিভু নিভু৷ কতদিন তো সূর্য ওঠেনি৷ তাই খাওয়ার টেবলে মোমবাতি৷ পাহাড়ের মাথায় ঝমঝমে বৃষ্টিতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার সেরে লেপের তলায় বসে অনেকক্ষণ আড্ডা তার পর ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া৷

রিকিসুম

হোমস্টের বারান্দা থেকে (বাঁদিক) ফরেস্ট বাংলোর ধ্বংসাবশেষ (ডানদিক)

পর দিন সবে ঘুম ভেঙেছে৷ সানরাইজ দেখার ইচ্ছে নিয়েই আগের রাতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম৷ এত বৃষ্টির পরদিন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায় সাধারণত। কিন্তু কোথায় কী? সাদা মেঘের দল খেলা করছে বারান্দায় সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি৷ ভোরের পাহাড় তখন মেঘ-বৃষ্টির দখলে৷ সঙ্গে প্রবল হাওয়া। হাওয়ায় হোম স্টের সেই স্বপ্নের মতো ব্যালকনিতেও যাওয়া যাচ্ছে না৷ লেপ মুড়ি দিয়েই জানলায় চোখ রাখলাম আমরা৷ জানলার কাঁচে চোখ রেখে যে কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল কে জানে। গরম গরম চা লেপের তলায় বসে শেষ করে পরের গন্তব্যের উদ্দেশে এক এক করে তৈরি হয়ে নিলাম।

আগেই খোঁজ পেয়ে গিয়েছি নতুন এক জায়গার৷ পথে দেখলাম রিকিসুম ফরেস্ট বাংলোর ধ্বংসাবশেষ। এখান থেকে চলে যাওয়া যায় সিলেরিগাঁও, পেডং, কালিম্পং, লাভা-লোলেগাও-এর মতো জায়গায়। আমরা যাব কোলাখাম৷ সকালে বৃষ্টি থামতেই গাড়ি ছুটল ন্যাওরাভ্যালি ফরেস্টের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক ছোট্ট গ্রাম কোলাখামের উদ্দেশে৷ সেই গল্প অন্য কোনও দিন বলব৷

ছবি: সুচরিতা সেন চৌধুরী

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)