বেনারসের সন্ধ্যারতি নাকি হরিদ্বারের, তুলনা চলতেই থাকে

বেনারসের সন্ধারতিবেনারসের মুন্সি ঘাট

বেনারসের সন্ধারতি আর হরিদ্বারের সন্ধ্যারতির মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য। যদিও দুটোই হয় গঙ্গাকে কেন্দ্র করে। সন্ধেবেলা গঙ্গাপুজো হয় আরতির মাধ্যমে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে হরিদ্বারের সন্ধ্যারতি বিশ্ব বিখ্যাত। খ্যাতির দিক থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে বেনারস। কিন্তু বেনারস কোথায় আলাদা তা না গেলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ঘুরে এসে সেই কথাই লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


সেবার বেনারসে ছিল বিরতি। গন্তব্য আরও খানিকটা দূর। যাব নৈনিতাল। কিন্তু ট্রেনে সে এক দীর্ঘ রাস্তা। আগেও গিয়েছি তবে বন্ধুদের সঙ্গে। বাবা-মাকে নিয়ে টানা দু’দিনের ট্রেন যাত্রা কঠিন হয়ে যাবে বলেই মাঝে বেনারস রাখা হয়েছিল। লখনউ আর বেনারসের মধ্যে লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিল ভারতের এই প্রাচীনতম শহরই। গঙ্গার পাড়ে গড়ে ওঠা এই শহর ঘিরে রয়েছে প্রচুর ইতিহাস। তবে ওই যে বললাম প্রাচীনতম শহর হওয়ার কারণ কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে শহর জুড়ে। যার প্রমান আমরা স্টেশনে নেমেই পেয়েছিলাম। তবে সে কাহিনী না শোনাই ভাল কারণ বাকিটা ভাললাগার।

গোটা একটা দিন-রাত ট্রেনে কাটিয়ে পর দিনে দুপুর দুপুর পৌঁছে গেলাম বেনারসে। আগের নাম বারানসী। কলকাতা থেকেই বুক করা ছিল হলিডেহোম। একটা বড় ঘর, সঙ্গে রান্না ঘর। বেনারসে তিন দিনের প্রোগ্রাম। তাই হাতে অনেক সময়। প্ল্যান ছিল রান্না করে খাওয়ারই। আগে একটা সময় পুরী, দিঘা বেড়াতে গেলে রান্না করে খাওয়ারই নিয়ম ছিল। এখ সে সব পার্ট চুকেছে। তবে সেটারও একটা মজা ছিল।

দশাশ্বমেধ ঘাটের সন্ধারতি

বেনারসের আনাচ-কানাচ জুড়ে রয়েছে নানা চেনা নামের কাহিনী। বেনারসে বসেই তুলসিদাস লিখেছিলেন ‘রাম চরিত মানস’। ১৫০৭-এ নাকি গুরু নানক পা রেখেছিলেন এই শহরে মহা শিবরাত্রীর জন্য। আর তার পরই সেখানে শিখ ধর্মের পত্তন হয়। তবে বেনারসের পুজো হয় শিবের। কাশি বিশ্বনাথ মন্দির বিখ্যাত। এ ছাড়া গোটা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর মন্দির। হিসেব বলছে ২৩ হাজার মন্দির রয়েছে সেখানে।

তবে বেনারসের বিখ্যাত সেখানকার ঘাট। এক একটি ঘাট দেশের এক একটি ইতিহাসকে বর্ণনা করে। বিখ্যাত ঘাটগুলোর মধ্যে রয়েছে দশাশ্বমেধ ঘাট, পঞ্চগঙ্গা ঘাট, মনিকর্ণিকা ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট। মনিকর্ণিকা ঘাট দেশের সব থেকে বড় শ্বশান। হরিশচন্দ্র ঘাটও শ্বশান। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু ফোর্ট। যেমন রামমনগর ফোর্ট তাদের মধ্যে বিখ্যাত।  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায় বেনারস একটি আলাদা ঘরানা সৃষ্টি করেছে। এখানকার বিখ্যাত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়।

দশাশ্বমেধ ঘাট

হিন্দু পুরান অনুযায়ী বেনারস বা বারানসী তৈরি করেছিলেন স্বয়ং শিব। ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি বেনারস বিখ্যাত তার বেনারসি শাড়ির জন্যও। তবে তার মূল্য সাধারণেক ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে সেখানকার বেনারসি পান চেখে দেখা যেতেই পারে। গোটা শহর অনেক বদলে গেলেও মুঘল ছাপ এখনও স্পষ্ট সেখানকার ঘর-বাড়ি এবং ঘাটগুলোয়। সব থেকে বিখ্যাত ঘাট দশাশ্বমেধ ঘাট। এখানেই হয় সেই মনোমুগ্ধকর আরতি। আর এই আরতি একটা জায়গায়ই আলাদা হরিদ্বারের থেকে।

প্রথম দিনটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে সরাসরি পৌঁছে গিয়েছিলাম দশাশ্বমেধ ঘাটে। যে ক’দিন ছিলাম রোজ দু’বেলা ওই ঘাটেই সময় কাটত। ইতিহাস কথা বলে ওই ঘাটের আনাচ-কানাচ। প্রথম দিনই বেনারসের সন্ধ্যারতি দেখার সুযোগ হয়েছিল। ঘাটের সিড়িতে ততক্ষণে মানুষের ঢল নেমেছে। কিন্তু পুরোটাই প্রচন্ড নিয়ম মেনে। কোনও হুড়োহুড়ি নেই। গঙ্গার দিকে মুখ করে বিশালাকার সব প্রদীপ নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা আরতি দেখে প্রথম দিনই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ঘণ্টা, কাসরের শব্দে বদলে যাওয়া এক অদ্ভুত পরিবেশ। তবে পরদিনের আরতি ছিল আরও ভাল। সেই অনুভূতি লিখে হয়তো পুরোটা বোঝাতে পারব না।

বেনারসের গঙ্গাকে ঘিরে রয়েছে ঘাট

আরতি শুরুর সঠিক সময় আগের দিনই জেনে গিয়েছিলাম। তার বেশ কিছু আগেই ঘাটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেদিনের পরিকল্পনায় ছিল নৌকো ভ্রমণ। নৌকয় ভাসতে ভাসতে দশাশ্বমেধ ঘাটের সেই আরতি এখনও চোখ বুঝলে দেখতে পাই। তখন ঠিক সন্ধে নামছে। পশ্চিম আকাশের রঙ বদলে সূর্য ডুবছে। গঙ্গার জলে তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে আর তখন উল্টো দিকে একটা একটা জলে উঠছে কয়েক শো প্রদীপ। লাইন করে দাঁড়িয়ে পূজারিরা হাতে তুলে নিচ্ছেন এক একটা প্রদীপ। পাগলের মতো ঘণ্টা বাজাচ্ছেন কেউ, ক্লান্তিহীন সেই হাতের চলাচল। কখনও কখনও ক্যামেরা ক্লিক করতেই ভুলে গিয়েছি। সব ঘাটেই জ্বলে ওঠে সেই একই সময়ে প্রদীপ। গঙ্গায় ভাসতে ভাসতেই সেদিন অন্ধকার নেমেছিল বেনারসে। প্রদীপের আগুনের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল মনিকর্ণিকা ঘাটের চিতার আগুন। কেউ বিলিন হয়ে যাচ্ছিলেন পঞ্চভূতে কেউ প্রদীপের জ্বলন্ত আগুনেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলেন।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)