রাবাংলায় স্নো-ফল আর চিলি পর্কের স্মৃতি আজও তাজা

রাবাংলায় স্নো-ফল

রাবাংলায় স্নো-ফল দেখে সেদিন মুগ্ধ হওয়াটা আজও একইরকম। তার পর বদলেছে অনেক কিছু কিন্তু সেই সময়ের স্মৃতি আজও অমলিন। চোখ বুজলেই সেই প্রথম বরফ পড়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই স্মৃতিই তুলে ধরলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


শীতটা তখন কলকাতা শহরে জাঁকিয়ে বসছে ক্রমশ। তার মধ্যে বৃষ্টি। ডিসেম্বর মাসে এই দু’য়ের যুগলে পারদ এতটাই নিম্নমুখি যে রীতিমতো হুহু করে কাঁপছে মানুষ। না হলে কলকাতায় হাতে গোনা এক সপ্তাহই ঠান্ডা পড়ে। সময়টা ২০০৪-০৫ হবে। কয়েকবছর আগেই সাংবাদিকতায় হাতেক্ষরি হয়েছে। নতুন এক মিডিয়ায় যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তার মধ্যেই হাতে এক সপ্তাহের ছুটি পেয়ে গেলাম এক সংবাদ মাধ্যম থেকে অন্য সংবাদ মাধ্যমে যোগ দেওয়ার মাঝে। মনে আছে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল।

কাজের শহরে শীত আমার মোটেও ভাল লাগে না। তাই ঠান্ডা পড়লেই মনটা পাহাড় পাহাড় করতে শুরু করে। বাড়ি ঢুকতেই বোন বলল, টিভিতে দেখিয়েছে পাহাড়ে বরফ পড়বে খুব দ্রুত। আর পায় কে আমাদের। ‘‘চল যাই’’। বোন বলল, ‘‘রিজার্ভেশন নেই।’’ তাতে কী। ট্রেন তো যাচ্ছে, কিছু একটা হবে।

সিকিমের একমাত্র চা বাগান, টেমি টি গার্ডেন

এই প্রস্তাব আমাদের বেশ কয়েকজন বন্ধুর কাছেও পৌঁছে গেল সেই রাতেই। রাতারাতি সম্মতি জানাল দু’জন। এর থেকে বেশি অপেক্ষা করার সময় নেই। পর দিনই দার্জিলিং মেল। তবে এসি কম্পার্টমেন্ট তো দুরঅস্ত, রিজার্ভ সিটেও জুটল না ভাগ্যে। তাতে অবশ্য উচ্ছ্বাসের খামতি নেই কারও। কুলিকে টাকা দিয়ে জেনারেলে একটা পুরো সিটের ব্যবস্থা হল। একটাই তো রাত। কত রাত এমনিই জেগে কাটাই এই জাগা তো পাহাড়ের জন্য। আড্ডা দিতে দিতে সকালে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি।

স্টেশনের বাইরে থেকে গাড়ি ভাড়া করে আমাদের গন্তব্য রাবাংলা। সেই প্রথম দক্ষিণ সিকিমের এই গঞ্জকে দেখা। এখন যদিও সেই রাবাংলা আর নেই। পৌঁছতে অনেকটাই সময় লাগল। ততক্ষণে পাহাড়ি ঠান্ডা টের পেয়ে গেছি। গাড়ির জানলা মাঝে মাঝে খুললেই দমকা হাওয়া এসে মুখে-চোখে সুঁচ ফোটাচ্ছে। রাবাংলা পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল।

সেখানে পৌঁছনে এক বড় বিপদের মুখে পড়লাম। ঠান্ডায় প্রায় সব কটা হোটেলই বন্ধ। তখন হাতে গোনা কয়েকটিই হোটেল ছিল সেখানে। স্থানীয় লোকেরা রাস্তার উপর বসেই আগুন পোহাচ্ছে। আমরাও হোটেল খোঁজার ফাঁকে সেখানে নিজেদের গরম করে নিলাম। কিন্তু উপায় কী, হোটেল না পেলে যাব কোথায় এই ঠান্ডায়? ঠিক তখনই ত্রাতা হয়ে এলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক।

হঠাৎই পিছন থেকে হাঁক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। তাও আবার বাংলায়। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ‘‘আমার হোটেল খোলা আছে, আমার হোটেল খোলা আছে।’’ এই শব্দ ক’টা আমাদের কাছে দৈববানীর মতো শোনাল। ইউরেকা বলে ঢুকে পড়লাম সেই বাঙালির হোটেলে। ততক্ষণে পেটে ছুঁচোরা ডন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও এগকারী আর ভাত জুটল, সেটাই অমৃত। হোটেল মালিকই জানালেন, সব হোটেল বন্ধ করে নিচে নেমে গিয়েছে। তিনিও এক দু’দিনের মধ্যে নেমে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। ভাগ্যিস জাননি।

বোরোং গুম্ফার পথে

দুপুরের খাওয়ার খেয়ে হোটেলের সামনে একটু হাঁটাহাঁটি করতে করতেই ঝপুৎ করে সন্ধে নেমে গেল। ঠান্ডায় রীতিমতো তখন দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার জোগার। গরম গরম কফিতে কিছুটা স্বস্তি এল ঠিকই কিন্তু রাতে রুম হিটার না হলে চলবে না। তাও জোগার হল। এই ঠান্ডায় রুম হিটারও কাজ করছে না। হোটেল মালিক জানালেন, আজ রাতে স্নোফল হবে। এই জন্যই তো এত কাণ্ড করে আসা। এর আগে কখনও স্নোফল দেখিনি।

রাতের খাওয়ার শেষ করে ঘরে লেপের তলায় বসে আড্ডাটা সবে জমে উঠেছে তখনই হোটেল মালিকের সেই চেনা হাঁক। ‘‘তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন, বরফ পড়ছে।’’ লেপের গরমকে পরাস্ত করে তখন স্নো ফল জিত গিয়েছে। ছুটে বারান্দায় এসে দেখলাম, পেজা তুলোর মতো বরফ ঝিরঝির করে পড়ছে সামনের রাস্তায়। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ছাদগুলো সাদা হয়ে উঠছে ক্রমশ। প্রায় সারারাত বরফ পড়েছিল। যতক্ষণ জেগেছিলাম হোটেলের টিনের ছাদে টুপটাপ শব্দ শুনেছি।

রাবাংলার অপূর্ব সৌন্দর্য্য

পরের দিন সকালটা ছিল আমাদের জীবনের সেরা অনুভূতি। গরম চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনিতে আসতেই দেখলাম রাস্তার দু’ধার দিয়ে জমে রয়েছে সাদা বরফ। রাস্তার বরফ পরিষ্কার করা হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। রাতেই হোটেল মালিককে জানিয়ে রেখেছিলাম পরের দিনের পরিকল্পনা। সেই মতো ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম সাইটসিন করতে। গাড়ি যত এগোচ্ছে ক্রমশ আমরা ঢুকে পড়ছি বরফ রাজ্যে। চারদিকে শুধুই বরফ। রাস্তার দু’পাশ, গাছের উপর, বাড়ির ছাদে, বরফ আর বরফ। অপূর্ব সেই দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। চোখের সামনে সেই দিনটা আজও ছবির মতো ভেসে ওঠে আর এক অদ্ভুত অনুভূতি আজও শিহরণ জাগায়।

সাইড সিনের পুরো রাস্তাটাই আসল বরফ দেখা, বরফ খেলা, বরফ খুনসুটির ছিল। অন্য কিছু মন দিয়ে দেখিইনি। তার মধ্যেই মনে আছে টেমি টি গার্ডেন। সিকিমের একমাত্র টি গার্ডেন। ফেরার পথে আবার প্রবল বৃষ্টি নামল। তার মধ্যেই হোটেলে ফিরলাম। উল্টোদিকের দিদির রেস্টুরেন্টের বাইরে ঝোলানো মেনুতে চিলি পর্ক দেখে প্রথম থেকেই লোভটা তৈরি হচ্ছিল। সবাই একমত হতেই সেখান থেকে চলে এল সেটা। সত্যি বলছি, এত ভাল চিলি পর্ক তার পর আমি খেয়েছি সল্টলেকের সিকিম হাউসের রেস্টুরেন্টে।

ওল্ড বোরোং মনাস্ট্রি

এই রাতে আর স্নোফল হয়নি। তবে ঠান্ডাটা জাকিয়ে বসেছিল। হোটেল মালিক বললেন, তাপমাত্রা মাইনাসে পৌঁছে গেছে। গোটা রাবাংলায় ট্যুরিস্ট বলতে শুধুই আমরা পাঁচজন। পর দিন সারাদিন বৃষ্টি শেষে যখন আকাশ পরিষ্কার হল তখন বিকেল হয়ে এসেছে। কোথাও বেরনো হয়নি। তাই বৃষ্টি কমতেই বেরিয়ে পড়লাম বোরং মনাস্ট্রি দেখতে। রাবাংলা থেকে বেশ কিছুটা দূর। আর খুব খারাপ রাস্তা। তার মধ্যেই চলল গাড়ি। পৌঁছনোর আগেই বৃষ্টি নামল। তার প্রাবল্য ঠিক কতটা ছিল বলে বোঝাতে পারব না। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর সঙ্গে বৃষ্টি। সামনের রাস্তা কোনও রকমে গাড়ির হেডলাইটে দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যেই পৌঁছলাম বোরং মনাস্ট্রিতে। প্রান হাতে করে হোটেলে ফিরেছিলাম সেদিন।

চিলি পর্ক, রুটি আর স্থানীয় ওয়াইনে সেদিন জমে গিয়েছিল ডিনার। যোগ দিয়েছিলেন হোটেল মালিকও। সেটাই শেষ রাত। তবে প্রথম রাবাংলা, প্রথম বরফ দেখা, প্রথম পর্ক খাওয়া, প্রথম ওয়াইন সব মিলে আজও স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল সেই দুটো দিন।

রাবাংলার মূল বাজার এলাকা

(বেড়ানোর আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)