সিঙ্গল হোম স্টে, চা বাগানের মধ্যে নিভৃতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ঠিকানা

সিঙ্গল হোম স্টে

সিঙ্গল হোম স্টে-তে নিভৃতে কাটাতে এক বন্ধুর কাছ থেকে খবরটা পেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন। দুটো দিন শুধুই হোম স্টে-র বারান্দা আর চা বাগানের ইতিউতি হেঁটে বেড়ানো। সঙ্গে হোম স্টে-র অসাধারণ আতিথেয়তায় দিনগুলো কেমন কেটেছিল লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


এক বন্ধুর কাছে বেশ কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম এই জায়গাটার গল্প। অতীতে কার্শিয়াংয়ে থেকেছি তবে সেটা রেলের প্রাচীন এক গেস্ট হাউসে। যেখানে ভৌতিক সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তার পর কার্শিয়াংয়ের উপর দিয়ে বহুবার দার্জিলিং গিয়েছি কিন্তু সেখানে আর থাকা হয়নি। কিন্তু সিঙ্গল হোম স্টে-র কথা শুনে লোভ সামলাতে পারলাম না। বেরিয়ে পড়লাম। আগেই ফোনে কথা হয়ে গিয়েছিল। কার্শিয়াং শহর থেকে বেশ খানিকটা বাইরে। হোম স্টে-র বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় শহর কিন্তু শহর আমাকে ছুতে পারে না সেখানে। এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে?

দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হোম স্টে-তে। সিঙ্গল চা বাগানের মধ্যেই দোতলা বাড়ির একটা তলায় তৈরি হয়েছে হোম স্টে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া টানা বারান্দা। যেখানে দাঁড়ালে যেমন সামনে বিস্তৃত চা বাগান। তেমনই চা বাগানকে ছাপিয়ে চোখ আটকে যাবে দূরের পাহাড়ের গায়ে। বাঁ দিকে চোখ ঘোরালে কার্শিয়াং শহরের কোলাহল‌। হঠাৎই চোখের সামনে দিয়ে কু ঝিকঝিক শব্দ করে কালো ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে দার্জিলিং বা শিলিগুড়ির উদ্দেশে চলে যাবে টয় ট্রেন। রাত নামলে পাহাড়ের গায়ে জলে উঠবে একের পর এক আলো। ঠান্ডা হাওয়া ছুয়ে যাবে। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে চেয়ার টেনে বসে মোবাইলে হালকা করে গুলজার চালিয়ে হারিয়ে যাওয়া যায় ওই বারান্দায় বসে। এমনই সিঙ্গল হোম স্টে।

শহুরে ভিড় থেকে কয়েকটা দিন শান্তিতে কাটানোর জন্য চলে যাওয়া যেতেই পারে। পৌঁছেই মালকিন অরুণা প্রধানের আতিথেয়তায় দীর্ঘ যাত্রার সব ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে সরাসরি চলে গেলাম লাঞ্চের জন্য। পাশেই খাওয়ার জায়গা। দারুণ রান্না। বিভিন্ন রকমের মেনু দিয়ে সাজানো থালা। তৃপ্তি করে খেয়ে একটু বিশ্রাম। বিকেলে চা নিয়ে হাজির স্বয়ং অরুণা। চায়ের সঙ্গে গল্পটাও জমে গেল। কীভাবে হোম স্টের পরিকল্পনা, সেখানকার মানুষ, ওঁদের বেঁচে থাকা সব নিয়ে কত কথা হল। তার মধ্যেই সন্ধে নামল। পাহাড়ের আলোগুলো জলে উঠলো। যেন পাহাড়ের গায়ে দীপাবলির প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে কেউ। সঙ্গে ঠান্ডাও বাড়ল। বারান্দায় বসেই পকোড়া সহযোগে গরম গরম কফি এল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

এমন পরিবেশে কখনও কখনও কথা হারিয়ে যায়। শুধুই অনুভব করতে হয় চারদিকের নিস্তব্ধতা। নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর এমন এক অনবদ্য সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইবেন না। তাই বাড়ির লোককে নিজের সংবাদ দিয়ে ফোনটাকে সাইলেন্ট করে দিন। প্রকৃতির শব্দ শুনুন। রাত বাড়লে ঝিঝির ডাকে মুখর হয়ে ওঠা গোটা এলাকা। ডিনারের ডাক আসে দ্রুত। পাহাড়ের দিন যেমন দ্রুত শুরু হয় তেমনই রাতও তাড়াতাড়ি হয়। ধিরে ধিরে নিভতে থাকে পাহাড়ের আলো। কিছু আলো সারারাত জলে। কিছু নিভে যায়। ঠান্ডা বাড়লে নিজেকে ঘর বন্দি করতেই হয়। লেপের তলায় বসে কিছুক্ষণ টিভিতে চোখ রাখা যেতেই পারে বা প্রিয় উপন্যাসের পাতায়। সময়টাতো একান্তই নিজের, যেভাবে ইচ্ছে কাটানো যেতে পারে।

সকালটা বেশ দেড়িতেই হল। তাও চায়ের ডাকে। সাইট সিন বা এই জাতীয় কোন‌ও পরিকল্পনা না থাকায় তাড়াহুড়ো নেই। চা, ব্রেকফাস্ট সেরে চা বাগানের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। বাগানের ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে কখনও রাস্তা ঊর্ধ্বমুখি তো কখনও নিম্নমুখি। কিছুটা দূর গিয়েই একটা উন্মুক্ত জায়গা দেখে চোখ আটকে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূরের শেষ পাহাড়টা পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় পাহাড়ের বদলে যাওয়া রঙের খেলা। আর ঠিক তখনই পাহাড়ি নিস্তব্ধতা ভেঙে ছুটে চলে যায় একপাল স্কুল ফেরত ছেলে-মেয়ে। বোঝা যায় বেলা বেড়েছে। ফিরতে হয় সুস্বাদু লাঞ্চের টানে।

বিকেলে আরও একবার বেরিয়ে পড়ি চা-বাগানের রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই চা ফ্যাক্টরির সামনে। সবুজ বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কংক্রিটের এক দালান যেন বড্ড বেমানান। এক স্থানীয় যুগলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সেই উন্মুক্ত রাস্তায়। ওরা একে অপরকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়ের দিকে মুখ করে। চোখাচোখি হতেই সেই চিরচেনা পাহাড়ি মানুষদের হাসি ছড়িয়ে দিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে ডুবে যায় ওরা। আমি ডুব দিই পাহাড়ি সবুজে। ফেরার সময় সিঙ্গলের মালকিন বলেন, ‘‘আবার আসবেন।’’ যেন কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। আত্মীয়ই তো। আত্মার সম্পর্কটা যে প্রথম দিনই হয়ে গিয়েছিল।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)