টেহরি ড্যামের নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষের মৃত স্বপ্ন

টেহরি ড্যামের নিচে ঘুমিয়েথেমে থাকা টেহরির জলাধার। —নিজস্ব চিত্র।

মেঘ বালিকা


জল কমে গেলেই জেগে ওঠে ছোট্ট একটা মন্দিরের ঘণ্টা ঘর। যেখান থেকে দিনের শুরু হত একটা গ্রামের, যেই ঘণ্টাই জানান দিত দিনের শুরু দিনের শেষ কোথায়। আর একটা দিনের অপেক্ষায় ঘুমোতে যেত গোটা গ্রাম। সেই গ্রামেরই মৃত স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে একটা জলাধার। প্রতিদিন ফুলে ফেপে ওঠে। আর সেই জলের নিচে ঘুমিয়ে থাকে কত কত মানুষের মরে যাওয়া স্বপ্ন।

টেহরি ড্যাম।  পাহাড় ঘেরা এক বিশালাকার জলাশয়। যা গিলে ফেলেছে একটা সম্পূর্ণ গ্রামকে। তার পাড়েই আজ ভ্রমনের পসরা, জলযানের ছুটে চলা তীব্র গতিতে। ছোট ছোট খাওয়ার স্টলে উৎসাহী মানুষের ভিড়। ওই দেখা যায় সবুজ জলের টেহরি ড্যাম। যার শরীরে ছায়া ফেলছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। ঠান্ডা হাওয়া, কখনও ঝুপুৎ করে নেমে আসা এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এমনটাই তো চায় ভ্রমণপিপাসু মানুষ। তবুও কখনও কানের পাশ দিয়ে ভেসে যায় কান্নার শব্দ।

টেহরি ড্যামের নিচে ঘুমিয়ে

টেহরি ড্যাম। —নিজস্ব চিত্র

কেউ বলছে, ‘‘মেরা ঘর, মেরা জমিন, মেরা জিনা খতম হো গ্যায়া। পাহাড় খতম হো গ্যায়া।’’ কেউ শোনেনি সেই চিৎকার। একলাখের উপর মানুষকে স্থানান্তরিত করা হয় এই গ্রাম থেকে। ভাগিরথীর জলকে আটকে ফেলা হয় ৫৭৫ মিটার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দেখা যায় পাহাড়ের খাঁজে জমে থাকা জলাশয়। অপূর্ব পরিবেশ। ড্যামের পাশেই রয়েছে থাকার জন্য অত্যাধুনিক জায়গা। হাতে পয়সা থাকলে আর সময় থাকলে এখানে একদিন কাটিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। শুধু লেকের ধারেই কেটে যাবে সময়।

কাবুলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

ধনৌলটি থেকে মুসৌরির উদ্দেশে বেরিয়েছিলাম। পথে যা যা দেখা যায় দেখে চলে যাব চির চেনা ও ভাললাগার পাহাড়ি শহর মুসৌরিতে। যেতে যেতেই ড্রাইভারই বললেন, ‘‘এখানে এসে তেহরি ড্যাম দেখবেন না?’’ পরিকল্পনায় ছিল না। নামটা শুনেই সব ইতিহাস মাথার মধ্যে কিলবিল করে উঠল। কষ্টের ইতিহাস বটে। পরিকল্পনা ছিল না, তাই টেহরি যাওয়া নিশ্চিত হতেই গাড়ির নির্ধারিত ভাড়ায় যুক্ত করতে হল আরও দেড় হাজার টাকা।

কিছুটা এগনোর পরই অনেকটা নিচে ধরা দিল টেহরি। পান্না রঙের টেহরি তখন আমাদের অপেক্ষায়। পাহাড়ের বাঁকের পর বাঁক পেড়িয়ে একটা সময় নেমে এলাম একদম লেকের পাড়ে। টলটলে জলে ট্যুরিস্ট নিয়ে তখন ছুটে চলেছে স্পিডবোট। কেউ ব্যাস্ত রোমান্টিক মেজাজে বোটিংয়ে। মন চাইল ওই জলের বুকে ঘুরে বেড়াতে। পাড়ে দাঁড়িয়েই সবুজ জলে পাহাড়ের ছায়ায় রোদের আঁকিবুকি দেখতে দেখতেই বৃষ্টি এল।

পাড় ধরে ছোট ছোট খাওয়ার স্টলের একটিতে আশ্রয় নিলাম। পকোড়া আর চা অর্ডার দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে সেই জলেই চোখ আটকে থাকল। অদ্ভুত ভাললাগা-খারাপ লাগার এক মিশেলে ডুবে থাকলাম পুরো সময়টা। এই লেকের ধারে অত ঠান্ডা নেই। দুপুরের রোদে গা শেকে নিচ্ছে গোটা এলাকা। থাকার জায়গাটা দেখে বেশ লোভ হল। ঝিলমুখো একটা ঘরে যদি একটা দিন কাটানো যেত?

টেহরি ড্যামের নিচে ঘুমিয়ে

টেহরি ড্যামে স্পিড বোট।

মনে মনে আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিতে পারলাম না প্রতিবার সব জায়গা থেকে ফেরার সময় যেমন দিই। ভাললাগাটাই সঙ্গে নিলাম উত্তরাখণ্ডের এই অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির কাছ থেকে।

এখানে ড্যামের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। তার পর থেকেই গ্রামবাসী ও পরিবেশবিদদের দীর্ঘ আন্দোলন চলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে ড্যাম। ২০০৬ সালে সেই ড্যাম উদ্বোধনও হয়েছে। এখান থেকে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়েছে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, দিল্লি, হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মীর, চণ্ডিগড়, রাজস্থান ও হিমাচল প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ১৯৯১এ রিখটার স্কেলে ৬.৮ ভূকম্পনে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। ড্যাম থেকে মাত্র ৫৩ কিলোমিটার দূরে ছিল উৎসস্থল। আরও বড় ভূমিকম্প যে কোনও দিন হতে পারে এই অঞ্চলে। তার পরিমান ৮.৫ও হতে পারে। যার ফলে ড্যাম ভেঙে ভেসে যেতে পারে বিস্তির্ণ এলাকা।