সিলারিগাঁও-এ ‘সিলি হাওয়া ছুঁ গ্যায়ি’, মেঘের দেশে রাত জাগে কাঞ্চনজঙ্ঘা

সিলারিগাঁওরামিতে থেকে নিচে রঙ্গিত

সিলারিগাঁও, যেখানে গাড়ির জানলা দিয়ে ঢুকে আসে মেঘের দল৷ সেই মেঘের দেশে বাড়ির দাওয়ায় খেলা করে প্রকৃতি৷ কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি আবার কখনও সূর্যের রশ্মি গায় ঘুম ভাঙানিয়া গান৷ প্রথম দেখার কথা লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


শহুরে কালিম্পংয়ের গণ্ডি পেড়তেই প্রকৃতি আরও জড়িয়ে ধরল৷ ডেলোকে বাঁ দিকে রেখে রাস্তা উর্ধ্বমুখী হল৷ সবুজের অবুঝ আস্ফালনে কখনও ঢাকা পড়ল আকাশ আবার কখনও উঁকি দিয়ে গেল জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে৷ সূর্যিমামা এখানে তেজ ছড়াতে পারেন না৷ তাই কনকনে ঠান্ডা হাওয়া মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছে পারদ ক্রমশ নিম্নমুখি। কালো পিচের রাস্তাকে পিছনে ফেলে ঘর ঘর শব্দে গাড়ি ধরল পাথুরে পথ৷ আমরা চলেছি সিলারিগাঁও৷ গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে তখন কাকতালীয়ভাবেই বেজে উঠল, ‘সিলি হাওয়া ছু গ্যায়ি’৷

আমাদের এবারের গ্রুপটা তুলনামুলকভাবে বড়৷ ছ’জনের দল৷ প্রকৃতি দেখতে দেখতেই কখন যেন এসে গেল গন্তব্য৷ পৌঁছে গিয়েছি সিলারিগাঁও৷ গ্রামের মুখিয়া বীরু তামাং ছুটে এলেন সপরিবারে৷ দু’কামরার ঘরে তাঁর ছোট্ট হোম স্টে৷ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে একটু উঠেই দু’পাশে দুটো ঘর৷ ঘর ভাগাভাগি করে নিতে নিতেই ডাক পড়ল লাঞ্চের৷ আসলে কালিম্পং থেকে বেড়তে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল৷ ততক্ষণ না খেয়েই বসেছিল ওঁরা৷ বীরু তামাং কখন যে বীরুচাচা হয়ে গেল টেরই পাইনি।

দুই সময়ে দুই রূপে কাঞ্চনজঙ্ঘা

ব্যালকনি থেকে সামনে দেখিয়ে বীরুচাচা বললেন ওখানেই কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ কিন্তু কোথায়? পুরোটাই তো মেঘে ঢাকা৷ চাচা আশ্বাস দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ আগেও পুরো দেখা যাচ্ছিল৷ আপনারা কাল দেখতে পাবেন৷ সেই আশা নিয়েই লাঞ্চ সেরে নিলাম৷ গরম গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা, আন্ডাকারি দিয়ে৷ এর পর কী? বিশ্রাম? যদি সেটা ভেবে থাকেন তাহলে একদম ভুল৷ খেতে খেতেই চাচার ছেলে দীপেন বলছিল রামিতের কথা৷ যেখান থেকে নিচে দেখা যায় রংপো, সিকিমের একটা অংশ আর সঙ্গে দারুণ সূর্যাস্ত৷ তখনই ঠিক করে নিলাম খেয়ে উঠেই বেড়িয়ে পড়ব সেই পথে৷ হেঁটে যেতে হবে নেহাৎই কম রাস্তা নয়৷

পেটে ভাত পড়তেই ঠান্ডা আরও জাঁকিয়ে ধরল৷ গরম জামা-কাপড় বেশি করে চাপিয়ে হাঁটা লাগালাম রামিতের দিকে৷ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে৷ কোথাও কোথাও বেশ গভীর সে জঙ্গল৷ সূর্যের আলো ঢোকে না৷ সেই পথ পেড়িয়ে রামিতেতে পৌঁছেই মন ভরে গেল৷ উধাও সব ক্লান্তি৷ চাচা বলেছিলেন কাল দেখতে পাব কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ কিন্তু দিন গড়াতেই সব মেঘ হঠাৎই উধাও৷ পরিষ্কার হয়ে গেল চোখের সামনে পর পর দাঁড়িয়ে থাকা বরফ ঢাকা শৃঙ্গরা৷ সেই সাদা বরফ ঢাকা পাহাড়কে  লাল রঙে রাঙিয়ে সূর্য ডুব দিল৷ তার পরেও যে আমরা কতক্ষণ রামিতের ওই একফালি পাথরের উপর বসেছিলাম মনে নেই৷ অনেক নিচে বহমান রংপোখোলার নীল জল, অন্যদিকে সিকিমের পাকিয়ং৷

স্থানীয় ট্র্যাডিশলান ডিশ

দীপেনের ডাকে সম্বিত ফিরল৷ এবার ফিরতে হবে ঘরে৷ এখানে পৌঁছয়নি বিদ্যুৎ৷ যে ক’দিন ছিলাম রোজ দীপেন আমাদের মোবাইল, ক্যামেরা ব্যাগে করে নিয়ে যেত কালিম্পংয়ে চার্জ করাতে। ফিরতে ফিরতেই ঝুপুৎ করে নেমে এল অন্ধকার৷ দীপেন হ্যাজাক জ্বালিয়ে রেখে গেল আমাদের বাড়ান্দায়৷ ছোটবেলায় দেখেছি আমার উত্তরবঙ্গের বাড়িতে এরকম হ্যাজাক৷ সঙ্গে এল গরম গরম মোমো৷ পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি হয়৷ তাই দ্রুত ডিনার সেরে এবার লেপের তলায়৷ পরদিনের যা পরিকল্পনা তাতে উঠতে হবে ভোর সাড়ে চারটের সময়৷ সেই রামিতে থেকে দেখব সূর্যদয়৷

যেমন বলা তেমন কাজ৷ লেপের তলা থেকে বেড়তেই জমে গেলাম ঠান্ডায়৷ তবে তাতে কী, সূর্যদয় দেখা তো আর ছাড়া যাবে না৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারে সবার হাতে একটা করে টর্চ৷ বেড়িয়ে পরলাম সেই জঙ্গলের রাস্তায়৷ বেশ গা ছমছমে একটা পরিবেশ৷ হনুমানের দল লাফালাফি করলেই ছ্যাৎ করে উঠছে বুকের ভেতরটা৷ অন্য কিছু নয় তো? দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম রামিতে ভিউ পয়েন্টে৷ সেই একই দৃশ্য আবার চোখের সামনে ধরা দিল৷ আগের দিন অন্ধকার নামতে দেখেছিলাম আর এদিন দেখলাম আলো ফুটতে৷ একটুও মেঘের দেখা নেই৷ সারাদিন একইভাবে আমাদের দেখা দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা৷

রামিতে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা (বাঁ দিক) নেপালরাজার গড় থেকে নিচে সিলারিগাঁও (ডান দিক)

রামিতে থেকে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে চললাম নেপাল রাজার গড় দেখতে৷ এই জঙ্গল যেমন ঘন, পাহাড় তেমন খাড়াই৷ রীতিমতো হাফ ধরে যায়৷ এতক্ষণ যেটা বলিনি, এই সিলারির সব থেকে বিখ্যাত, কুখ্যাতও বলতে পারেন সেই জোঁকের সাক্ষাৎ পেলাম এই জঙ্গলে৷ দলের সকলের পায়েই বেশ খানিক্ষণ করে চিপকে থাকলেন তারা৷ তার পর অনেক কষ্টে ছাড়ানো হল৷ রক্তখেঁকো রাজার কাহিনীর সঙ্গে জোঁকের বেশ মিল খুঁজে পেলাম৷ ফেরা সেই একই পথে৷ লাঞ্চ সেরে দুপুরে আর বিছানায় গা না এলিয়ে গ্রামের রাস্তায় এদিক সেদিক হেঁটে বেড়ালাম৷ এদিন যেন কাঞ্চনজঙ্ঘা নির্ভয়৷ সারাদিন এমনকী রাতেও ধরা দিল একইভাবে৷ অমাবস্যার রাত না হলে চাঁদের আলোয় হয়তো মায়াবী হয়ে উঠত পরিবেশ৷

পাহাড়ে ফুল আর শিশু দুই-ই বড় সুন্দর

এখানে বলে রাখা ভাল, এই প্রথম কালিপুজো কাটিয়েছিলাম অন্ধকারের মধ্যে। স্থানীয়দের অদ্ভুত নিয়মের পুজো দেখে। না, শহুরে দীপাবলীর রোশনাই মিস করিনি। তার পর আরও অনেকবার গিয়েছি সিলারিগাঁওয়ে। এখন বিদ্যুৎ এসেছে সেই গ্রামে। একটা হোম স্টে থেকে এখন অসংখ্য থাকার জায়গা। ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। তবুও সিলারিগাঁও-এর ভাললাগা একটুও কমেনি। তবে বর্ষায় না যাওয়াই ভাল, কারণ জোঁকের বড্ড উৎপাত।

ছবি: সুচরিতা সেন চৌধুরী

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)