চার পাশে প্যাপিরাস আর শালুকের জঙ্গল, অজস্র পাখি, তার মধ্যেই দেখা মিলল শুবিলের

চার পাশে প্যাপিরাস আর শালুকের জঙ্গল, অজস্র পাখিচার পাশে প্যাপিরাস আর শালুকের জঙ্গল, অজস্র পাখি

তো যাওয়ার দিনক্ষণ তৈরি। কিন্তু, সাতসকালে উঠতে দেরি হল। বেজে গেল প্রায় সাড়ে ৬ টা। উত্তেজনায় সকালের খাবার তৈরি করে আর খেতে ইচ্ছে করল না। ধুত্তোর খাবারের নিকুচি করেছে, বলে বেরিয়ে পড়লাম। লিখছেন জয়ন্ত দত্ত


নতুন জায়গায় এসেছি। মাত্র কয়েক দিন হল। প্রাথমিক বিষয়, মানে অফিসে যোগ দেওয়া, নতুন দায়িত্ব বোঝা, এ সব সামলে উঠতে সপ্তাহ তিনেক কেটে গিয়েছে। মনটা বেশ উশখুশ করছে। কারণ, এখানে কত পাখি দেখছি— অনেকগুলোই অচেনা। কিন্তু এখনও ক্যামেরা ব্যাগ থেকেই বার করতে পারলাম না! অফিসে আমার কেবিনের জানলার পাশেই একটা গাছে সারা দিন অনেক পাখি দেখি, কিন্তু অফিসে কি ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যায়!

এখানে সব থেকে বেশি হয প্যাপিরাস— যে গাছ থেকে কাগজ তৈরি হত। জায়গাটা এখন সংরক্ষিত, কারণ বিলুপ্তপ্রায় কিছু পাখির দেখা পাওয়া যায় এখানে। যার মধ্যে রযেছে শোয়েবিল, নীল সোয়ালো, প্যাপিরাস গনোলকের মতো পাখি।

সপ্তাহ তিনেক অফিস থেকে ঘর, আর ঘর থেকে অফিস করতে করতে বিরক্ত হয়ে ঠিক করলাম, কোথাও ঘুরে আসি একটা সারা দিন। গুগল করে একটা জায়গা বেশ মনে ধরল। নাম ‘মাবাম্বা সোয়াম্প’। এটা লেক ভিক্টোরিয়ার পাশে একটা জলা জমি। ওহো, বলতেই ভুলে গিয়েছি। আমি এখন উগান্ডায়। আর লেক ভিক্টোরিয়া হল আফ্রিকার সব থেকে বড় হ্রদ— প্রায় ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ৩টি দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সে। আর কে না জানে, এই হ্রদই নীল নদের উৎস।


এই সংক্রান্ত আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন

জলা জমি শুনে কি একটু কেমন-কেমন লাগল? মনে হচ্ছে কি, জলা জমিতে কেউ আবার ঘুরতে যায় নাকি? কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই জলা জমিটা বেশ বড়। প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর নিয়ে ছড়ানো। এখানে সব থেকে বেশি হয প্যাপিরাস— যে গাছ থেকে কাগজ তৈরি হত। জায়গাটা এখন সংরক্ষিত, কারণ বিলুপ্তপ্রায় কিছু পাখির দেখা পাওয়া যায় এখানে। যার মধ্যে রযেছে শুবিল, নীল সোয়ালো, প্যাপিরাস গনোলকের মতো পাখি।

তো যাওয়ার দিনক্ষণ তৈরি। কিন্তু, সাতসকালে উঠতে দেরি হল। বেজে গেল প্রায় সাড়ে ৬ টা। উত্তেজনায় সকালের খাবার তৈরি করে আর খেতে ইচ্ছে করল না। ধুত্তোর খাবারের নিকুচি করেছে, বলে বেরিয়ে পড়লাম।

চার পাশে প্যাপিরাস আর শালুকের জঙ্গল, অজস্র পাখি

কাঁচা লাল মাটির রাস্তা, দু’পাশে অল্প জঙ্গল মতো।

আবার ঝামেলা! কিছু দূর গিয়ে দেখি, রাস্তার উপর বড় বাজার বসেছে! আর গাড়ি চলেছে শামুকের গতিতে! কোনও ক্রমে ভিড় কাটিয়ে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠলাম। প্রায় ৪০ মিনিট পর আবার হাইওয়ে থেকে ভেতরের কাঁচা রাস্তা ধরে ঢুকে পড়েই মন খুশি। কাঁচা লাল মাটির রাস্তা, দু’পাশে অল্প জঙ্গল মতো।

মাঝিদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানলাম যে, ভদ্রলোক ইউনেস্কোতে কাজ করেন। ছবি তুলতেও ভীষণ ভালবাসেন। মহিলা দু’জন অর্নিথোলজিস্ট মানে পক্ষীবিশারদ। খুব ইচ্ছে ছিল, সবাই মিলে একটা নৌকা নেব। যাতে, পকেট বেশি হালকা না হয়। কিন্তু, মাঝিরা বলল, আলাদা যাওয়াই নিয়ম।

১৫ কিলোমিটারের মতো যাওয়ার পর একটা বাঁক নিতে হবে। ডান দিকে— যেটা পাহাড়ে উঠছে। কিন্তু ডান দিকে ঢুকেই দেখি, রাস্তাটা আবার দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে আর তত ক্ষণে যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। জয় মা— বলে ডান দিক ধরে বেশ কিছুটা গিয়ে দেখলাম, পাহাড়ের একটা কোণে গিয়ে পৌঁছেছি, যেখান থেকে আর রাস্তা নেই। বেশ কষ্ট করে গাড়ি ঘুরিয়ে এসে অন্য রাস্তা ধরলাম। মনে হল, ঠিকই চলেছি। কারণ রাস্তাটা পাহাড় ঘুরে নীচের দিকে নামছে আর বাঁ দিকে গাছের ফাঁকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে লেক।

বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে দেখলাম, লেকের একটা কোণের দিকে এসে পড়েছি। বেশ কিছু নৌকা দেখা যাচ্ছে। দু’টো দোকান আছে। মানে ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। যদিও কোনও ভিড় নেই। আমাকে নিয়ে চার জন। এক জনের হাতে ক্যামেরা দেখে বুঝলাম, তিনিও ছবি তুলতে ভালবাসেন। অন্য দু’জন বয়ষ্ক মহিলা। মাঝিদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানলাম যে, ভদ্রলোক ইউনেস্কোতে কাজ করেন। ছবি তুলতেও ভীষণ ভালবাসেন। মহিলা দু’জন অর্নিথোলজিস্ট মানে পক্ষীবিশারদ। খুব ইচ্ছে ছিল, সবাই মিলে একটা নৌকা নেব। যাতে, পকেট বেশি হালকা না হয়। কিন্তু, মাঝিরা বলল, আলাদা যাওয়াই নিয়ম। কারণ, একটা নৌকাতে মাঝি বাদে দু’জনের বেশি বসা যায় না। তখন একটু খারাপ লাগলেও পরে বুঝেছিলাম, ওরা কেন বলেছিল।

কাঁচা লাল মাটির রাস্তা, দু’পাশে অল্প জঙ্গল মতো।

ঘণ্টাখানেক খোঁজার পর হঠাৎ আকাশে একটা শুবিলের দেখা মিলল।

নৌকার মাঝি-ই গাইড। নিয়ে চলল। প্রথমে তো দেখি, অথৈ জল— যার শেষ দেখা যায় না। কিছু ক্ষণ পরেই দেখলাম, ছোট্ট খাঁড়ির মধ্যে, মানে জলা জমিতে ঢুকে পড়েছি। চার পাশে তখন পাখির ডাক ছাড়া অন্য কোনও আওয়াজ নেই।

মুহূর্তে মন আনন্দে ভরে গেল। কোনও দূষণ নেই। গাড়ির আওয়াজ নেই। হাতে গোনা ৩টি ডিঙি নৌকা ছাড়া আর কিছুই নেই।

ঘণ্টাখানেক খোঁজার পর হঠাৎ আকাশে একটা শুবিলের দেখা মিলল। তার পর সে বেশ কিছুটা দূরে একটা ঝোপের মধ্যে নামল। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে চললাম সেই ঝোপের দিকে। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ লাগল পৌঁছতে। গিয়ে দেখলাম অতিকায় এক পাখি। দেখেই ভয় লাগে। বুঝলাম কেন শোয়েবিল বলে। কারণ, এদের ঠোঁট অনেকটা জুতোর মতো।

প্রথমেই শুরু হল শুবিল খোঁজা। এই পাখিটা খোঁজার জন্যই মূলত এখানে এসেছি। মাঝিরা দেখলাম জানে যে, কোন অঞ্চলে থাকতে পারে ওই পাখি। শুবিল একা থাকতে পছন্দ করে, ঘন ঝোপের মধ্যে। ডিঙি এখন আর আরামে চলছে না। ঘন জলা ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছে। চার পাশে প্যাপিরাস আর শালুকের জঙ্গল। অজস্র পাখি। এই জলায় প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির বাস। মনের আনন্দে ছবি তুলে চলেছি। কিন্তু, এখনও শুবিলের দেখা পেলাম না।

ঘণ্টাখানেক খোঁজার পর হঠাৎ আকাশে একটা শুবিলের দেখা মিলল। তার পর সে বেশ কিছুটা দূরে একটা ঝোপের মধ্যে নামল। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে চললাম সেই ঝোপের দিকে। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ লাগল পৌঁছতে। গিয়ে দেখলাম অতিকায় এক পাখি। দেখেই ভয় লাগে। বুঝলাম কেন শুবিল বলে। কারণ, এদের ঠোঁট অনেকটা জুতোর মতো।

ঘণ্টাখানেক খোঁজার পর হঠাৎ আকাশে একটা শোয়েবিলের দেখা মিলল।

এদের ডানা প্রায় ৮ ফুট লম্বা হয়। প্রিয় খাবার বলতে, বড় মাছ, সাপ আর কুমির ছানা।

তত ক্ষণে ৩টি ডিঙিই একসঙ্গে এসে পড়েছে। অর্নিথোলজিস্ট ভদ্রমহিলারা কিছু নোট নিলেন। তার পর ফিসফিস করে এই পাখিদের সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত খবর দিলেন— এখন গোটা পৃথিবী জুড়ে ৪ হাজারের মতো শুবিল বেঁচে আছে। এদের ডানা প্রায় ৮ ফুট লম্বা হয়। প্রিয় খাবার বলতে, বড় মাছ, সাপ আর কুমির ছানা। এরা ভাসমান দ্বীপ বানায় ডিম পাড়ার জন্য। আর মহিলা-পুরুষ দু’জনেই ডিমে তা দেয়। আর বাচ্চা প্রায় ৫ মাস বড় হওয়া পর্যন্ত একসঙ্গে যত্ন করে।

কাঁচকলাকে কলাপাতায় মুড়ে, সেদ্ধ করা হয়। আধা সেদ্ধ হলে তার মধ্যে চিনেবাদাম দিয়ে আবার সেদ্ধ করা হয়। এর পর পুরো সেদ্ধ হলে সেটাকে ভাল করে মিশিয়ে নুন আর টোম্যাটো দিয়ে খেতে দেয়। খিদের মুখে অমৃত লাগলো! আর বুঝলাম, কী মারাত্মক এনার্জি দেয় এই খাবার।

অনেক ক্ষণ ধরে ছবি তুলে চলেছি। তত ক্ষণে সূর্য প্রায় মাথার উপর। বেশ গরম লাগছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরা শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে ফিরে এলাম পাড়ে। আসার সময় অনেক মাছরাঙা দেখলাম। বি ইটার, আফ্রিকান জাকানা, ঈগল, হোমারকপ, গ্রেট কর্মোরান্ট, ব্লাক উইং স্টিল্টেরও দেখা পেলাম।

ডাঙায় পৌঁছে মনে হল, খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। চায়ের খোঁজে গিয়ে দেখলাম একটা দোকানে কিছু একটা খাবার তৈরি হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সেটার নাম মাতুকে। কাঁচকলাকে কলাপাতায় মুড়ে, সেদ্ধ করা হয়। আধা সেদ্ধ হলে তার মধ্যে চিনেবাদাম দিয়ে আবার সেদ্ধ করা হয়। এর পর পুরো সেদ্ধ হলে সেটাকে ভাল করে মিশিয়ে নুন আর টোম্যাটো দিয়ে খেতে দেয়। খিদের মুখে অমৃত লাগলো! আর বুঝলাম, কী মারাত্মক এনার্জি দেয় এই খাবার।

এদের ঠোঁট অনেকটা জুতোর মতো।

এদের ঠোঁট অনেকটা জুতোর মতো।

পেট ঠান্ডা করে গাড়িতে ওঠার আগে দেখি, মাছ বিক্রি হচ্ছে। জলা থেকে ধরা টাটকা মাছ। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি, বেশ বড় মাপের ভেটকি আর তেলাপিয়া। দামও বেশ সস্তা। ভারতীয় মুদ্রায় ২৫০ টাকা মতো কেজিতে ভেটকি পেয়ে মনে আনন্দ আর ধরে না।

ঠিক করলাম পরের বার আরও ভোরবেলা বেরোতে হবে। যাতে, ভোরের আলোয় ওই পরিবেশে আরও বেশি ক্ষণ থাকতে পারি। আর আরও কিছু নতুন পাখি দেখতে পারি। মাঝিরা বলেছে, পরের বার আরও ভেতরের জলায় নিয়ে যাবে।

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)