Sanjay Van Trek-এ ভূত দেখিনি, ইতিহাস ছুঁয়ে প্রকৃতিই চ্যাম্পিয়ন

Sanjay Van Trek

সুচরিতা সেন চৌধুরী: বেড়ানোর অনেক বিকল্প এখন। একটা সময় ছিল যখন সারা বছর ধরে পরিকল্পনা করে, লোকজন জোগার করে বেড়াতে যেতে হত। সে একদিনের ট্যুর হলেও। এখন সেই সব আর নেই। বরং এতো বিকল্প রয়েছে যে হঠাৎ করে ইচ্ছে করলেই বেরিয়ে পড়া যায়। সে গ্রুপে বা একা। বর্তমান সময়ে সোলো ট্রিপের খুব চল হয়েছে। অনেকেই একা একা ঘুরতে ভালবাসে। নিজের মতো করে ঘোরা যায়, খাওয়া যায়, জায়গাটাকে উপভোগ করা যায়। তবে এখন আরও একটি নতুন ঘোরার পন্থা আবিষ্কার হয়েছে। আমি যেটা পেয়েছিলাম দিল্লিতে। ভারতের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন জায়গার মানুষ পেশার টানে এসে সাময়িক আস্তানা তৈরি করে। যে কারণে বন্ধুত্ব, যোগাযোগ তৈরি হতে কিছুটা হলেও সময় লাগে। সেই সময়গুলোতে কাজ শেষে তাঁরা বড্ড একলা হয়ে পড়ে। কিছু করার থাকে না। কিন্তু ঘুরতে চাইলে দারুণ বিকল্প রয়েছে রাজধানী শহরে (Sanjay Van Trek)।

তেমনই একটি গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমারই বন্ধু পৃথা। তখন লকডাউন পুরোটাই শিথিল হয়ে গিয়েছে। মানুষ রাস্তায় বেরচ্ছে, ঘুরতেও যাচ্ছে। তবে সাবধান হয়েই। মাস্ক বাধ্যতামূলক তখনও। লকডাউনে আটকে দীর্ঘদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। বাড়ি থেকে দূরে দিল্লিতে তখন একাই থাকি। পৃথার থেকে বিষয়টি শুনে বেশ লোভ হল। জানা গেল ‘শায়ের-ই-দিল্লি’ নামে একটি গ্রুপ রয়েছে। তারাই বিভিন্ন ছোট ছোট দিনের ট্যুর আয়োজন করে দিল্লির বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গায়। আর এটা কারও অজানা নয়, দিল্লি ইতিহাসের খাজানা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেদিকেই চোখ যাবে দেখা মিলবে মোঘল স্থাপত্যের নানান নিদর্শন। তাই দ্বিতীয়বার না ভেবে স্পট বুক করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য ‘সঞ্জয় বন’।

এই সঞ্জয় বন নিয়ে অনেক ভৌতিক গল্পও রয়েছে। এই জায়গাটি নাকি ভৌতিক। তাই পুরো বেড়ানোটাই দিনের আলো থাকতে থাকতে। তবে দিল্লির কিছু কিছু হন্টেড জায়গায় রাতের ট্যুরও হয়। দক্ষিণ দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে সঞ্জয় বন পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগল না। গেটের বাইরে দেখলাম এক এক করে জমা হলেন প্রচুর মানুষ। কেউ পরিবারের সঙ্গে আবার কেউ বন্ধুর সঙ্গে। অনেককে দেখলাম একাই এসেছেন এই ট্যুরে যোগ দিতে। আসলে যখন ট্যুরটা শুরু হল তখন একটা পুরো গ্রুপ প্রায় ৩০-৪০ জনের, তাই কেউই একা নন। সবার সঙ্গে সবার বন্ধুত্বও হয়ে গেল। হেঁটেই ঘোরা হবে বিশাল এই জঙ্গল, পাহাড়ে ঘেরা এলাকা। সম্প্রতি সাজিয়ে তোলা হচ্ছে সঞ্জয় বনকে। যাতে ভূতের ভয়ে ভ্রমনার্থীরা দূরে সরে না থাকে।

Sanjay Van Trek

৭৮৪ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে জঙ্গল। যার কোথাও ঘন আবার কোথাও হালকা গাছ। পাথুরে উঁচু নিচু পথ দিয়ে শুরু হল আমাদের হাঁটা। শুরুতেই দেখা হয়ে গেল বিশাল জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছে বিশ্রামরত ময়ুরের সঙ্গে। সেও বিশ্রামের ফাঁকে দেখে নিল আমাদের। সে যে এমন লোকের ভিড় দেখে অভ্যস্ত সেটা বোঝাই গেল। আমরাও এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। একটি লোহার গেট টপকে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের মধ্যে। রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ি এলাকা ঢাকা রয়েছে সবুজ গাছে। মার্চে দিল্লিতে খুব বেশি গরম পড়ে না। সেটাই যা স্বস্তি। তবে এই সব ট্যুরগুলো শীতেই করার চেষ্টা করা হয় কারণ দিল্লির গরম সম্পর্কে তো সবাই ওয়াকিবহাল।

যত উঠছি ততই সৌন্দর্য্যের ভাড়ার যেন উন্মুক্ত হচ্ছে চরাচর জুড়ে। চারদিকের আকাশ যেখানে দিগন্তে মিশেছে সেখানে চলে যাচ্ছে চোখ। দূরে দেখা যাচ্ছে শহুরে দিল্লি। একফ্রেমে ইতিহাস, শহর, জঙ্গল আর আরাবল্লি পাহাড়ের এমন অস্তিত্বকে বন্দি না করে পারা যায়। তাই ট্রেকের সঙ্গে সঙ্গে চলল ছবি তোলাও। একটা সময় এমন একটা জায়গার সামনে এসে দাঁড়ালাম যেখানে কোনও রকমে এক পায়ে পার হতে হবে। মানে রাস্তাটা এতটাই সরু যে দু’পা পাশাপাশি রাখা যাবে না। তার মধ্যে দু’দিক ফাঁকা। ধরার কিছু নেই। নিচে বেশ খানিকটা খাদ। টলতে টলতে পেরিয়ে গেলাম সকলেই। কাঁটা জঙ্গল, বড় গাছের জঙ্গল পেড়িয়ে উঠে এলাম একদম টপে। যেখান থেকে চোখ ঘোরালে পুরো দক্ষিণ দিল্লিটা দেখা যায়। তবে সব থেকে অপূর্ব লাগছিল কুতুবমিনারের চূড়াটা দেখতে। জঙ্গল পেড়িয়ে যেন হাতছানি দিয়ে ওর ইতিহাস শোনাতে ডাকছে আমাদের। সঞ্জয় বন থেকে কাছেই কুতুব মিনার।

Sanjay Van Trek

আমরা দেখতে না পেলেও শুনলাম বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখতে পাওয়া যায় এই জঙ্গলে। ময়ুর ছাড়া এখানে রয়েছে এশিয়ান কোয়েল, হোয়াই ব্রেস্টেড কিংফিশারসহ আরও অনেক পাখি। এই সঞ্জয় বনেই শায়িত রয়েছেন সুফি সাধক হজরত শেখ শাহাবুদ্দিন আশিকাল্লার দেহ। বলা হয় রাতের অন্ধকারে এই জঙ্গলে হেঁটে বেড়ান সেই সাধক। সেখানে প্রতি রাতে জ্বালানো হয় মোমবাতি। এই জঙ্গলের মধ্যেই চোখে পড়ল কিছু একটার ধ্বংসস্তুপ। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এটি ছিল কিলা রাই পিথোরা। তারই একটি দেওয়ালের অংশ এখনও থেকে গিয়েছে। কেউ বলে এই এলাকায় ঘুরতে দেখা গিয়েছে অজানা এক মহিলাকে। চোখের সামনে কেউ কেউ তাঁকে হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে যেতেও দেখেছে। কখনও কান্না আবার কখনও হাসির আওয়াজ শুনেছেন স্থানীয়রা। সঞ্জয় বনের পড়তে পড়তে রয়েছে সেই অজানা মহিলার কাহিনী। শুনলাম রাতে এখানে অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পও হয়। সাহস থাকলে সেই সুযোগটা নেওয়া যেতেই পারে।

জঙ্গল থেকে বেরতে বেরতে আমাদের সন্ধে গড়িয়ে গেল। ততক্ষণে রাতের কুতুবমিনারের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। কুতুবমিনারের আলো ভিতরে থেকে দেখেছি তার অপূর্ব রূপ। তবে এতটা দূর থেকে সেই আলো যেন মায়া একে দিচ্ছে চোখে। জ্বলে উঠেছে চারপাশের শহরের আলো। ভিতরে না ঢুকলে বুঝতেই পারতাম না রাজধানী শহরের মধ্যেই রয়েছে এমন বিস্তির্ণ জঙ্গল-পাহাড় এলাকা। এর ভিতরে ঢোকার রয়েছে পাঁচটি গেট। ভিতরে রয়েছে পাঁচটি জলাশয়, যা তৈরি করা হয়েছে সম্প্রতি জঙ্গলকে বাঁচাতে। এই জঙ্গলেই রয়েছে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট। এখানে ট্রেকিং ছাড়াও সাইক্লিং, ওয়াকিং, বার্ড ওয়াচিং, রক ক্লাইম্বিং করা যায়। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে, তবে যাওয়ার আগে খোঁজ নিয়ে যাওয়াই ভাল। ভিতরে কোনও কিছু পাওয়া যায় না তাই সঙ্গে জল আর শুকনো খাবার রাখাটা জরুরি কারণ পুরো ট্রেকিটা শেষ হতে ঘণ্টা দু’য়েক লেগে যায়।

Sanjay Van Trek

কীভাবে যাবেন— দিল্লি-নৈনিতাল রোডের উপর অবস্থিত এই জঙ্গল। দিল্লি রেল স্টেশন বা বিমানবন্দর থেকে ক্যাব বা অটো নিয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় এখানে। তবে, সস্তায় দ্রুত পৌঁছতে হলে দিল্লিতে মেট্রোর কোনও বিকল্প নেই। সঞ্জয় বনের কাছাকাছি রয়েছে পাঁচটি মেট্রে স্টেশন। সেগুলি হল, কুতুবমিনার, আরকে পুরম,লিট দিল্লি, সাকেত ও মালভিয়া নগর মেট্রো স্টেশন।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle