ঋষিখোলা: সেখানে ঋষি নেই ঠিকই কিন্তু প্রকৃতির খোলা জানলা আছে

ঋষিখোলা

ঋষিখোলা গ্রামে নামটি হয়েছে ঋষি নদীর থেকে। এবং স্থানীয় ভাষায় নদীকে খোলা বলা হয়। সে থেকেই ঋষিখোলা। নদীর পাড়ের এক ছোট্ট নির্জন গ্রাম। যেখানে পৌঁছে গেলে মনে হবে গোটা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন। লিখলেন সুচরিতা


তালিকায় বেশ কয়েকটি জায়গা ছিল। ভৌগলিকভাবে সেগুলি বিচার করতে গেলে পুরো বিষয়টাই ঘেটে যাবে। কারণ এভাবে কেউ ঘোর না। কোনও উত্তরে তো কোনও দক্ষিণে। তবে আমার ঘোরা মানেই এমন উল্টোপাল্টা। বর্ষার পাহাড় তাই খালি, আগাম বুকিংয়ের প্রয়োজন নেই। সেকারণে যে কোনও সময় বদলে ফেলা যাবে ডেস্টিনেশন। তবে শুরুটা নিশ্চিত করেই শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেলে চেপেছিলাম। ঋষিখোলা ।

সকাল সকাল নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছে একটা ছোটগাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম ঋষিখোলার উদ্দেশে আমি আর বান্ধবী। দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ঋষিখোলা নদীর উপর ব্রিজে। এখানে আগাম বলে রাখা ছিল থাকার জায়গা। কিন্তু যেখানে গাড়ি নামিয়ে দিল সেখানে কোনও ঘর-বাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির চালক যা দেখালেন তাতে নেমে যেতে হবে নদীর কাছে কিন্তু রাস্তা কোথা?

ব্রিজের শেষেই একটা পুলিশ চৌকি দেখে একটু স্বস্তি পেলাম। তাঁদের কাছে ঋষিখোলা পৌঁছনোর রাস্তার কথা জানতে চাইতেই তাঁরাও দেখিয়ে দিলেন নদীর দিকে। ‘‘কিন্তু পৌঁছবেন কী করে বৃষ্টিতে তো ব্রিজ ভেসে গিয়েছে,’’ বললেন একজন পুলিশ। সব্বনাশ, তাহলে? অনেকবার ফোন করার পর যেখানে বুকিং ছিল সেখানের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। হোম স্টের মালিক জানালেন তিনি নেই। তবে আমাদের ব্রিজের উপর দাঁড়াতে বললেন। ব্রিজের উপরই এক ঘণ্টা কেটে গেল।

হঠাৎই পাহাড়ের ফাঁক থেকে বেড়িয়ে এল একটি ছেলে। এসে বলল ‘‘চলুন।’’ আমি বললাম, ‘‘কোথায়, কীভাবে? শুনলাম ব্রিজ ভেঙে গিয়েছে।’’ ছেলেটে শুনে বলল, ‘‘হ্যা, ওখানে পৌঁছতে হলে এই পাহাড়ের গা দিয়েই যেতে হবে। আর আপনারা না যেতে চাইলে টাকা ফেরৎ দেওয়া হবে।’’ সত্যি কথা বলতে কী ব্রিজের উপর থেকে কোনও রাস্তাই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ছেলেটি ভরসা দিল, আমরাও হাঁটা লাগালাম।

সত্যিই রাস্তা নেই। পাহাড়ের গা ঘেঁষে শরু স্থানীয় মানুষদের পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া রাস্তা। সেখান দিয়েই হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। কিছু দূর যাওয়ার পর বড় বিপদের সম্মুখিন হলাম। বিপুল জলরাশি পাহাড় থেকে নেমে রাস্তা ভাসিয়ে নেমে গিয়েছে নদীতে। পাথড় ধরে ধরে কোনও রকমে পেরিয়ে গেলাম সেই জায়গা। পা হরকালে একদম নীচে নদীতে পড়া কেউ আটকাতে পারত না। তবে এর পরই আত্মবিশ্বাসটা অনেকটাই বেড়ে গেল। এই পথে আরও অনেক এমন ঝর্ণা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে এক ঘণ্টা লেগে গেল।

ততক্ষণে পেটে রীতিমতো ছুঁচো ডন দিচ্ছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে আরও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখে পড়লাম। একটিও লোক নেই ত্রিসীমানায়। ওই ছেলেটি তার বোন আর আমরা দু’জন। কোনও রান্না নেই। তাই ম্যাগি দিয়েই লাঞ্চ সারতে হল। রাতে চিকেন রাঁধবে বলল সঙ্গে ভাত। সব ক্লান্তি অবশ্য ততক্ষণে কাটিয়ে দিয়েছে ঋষিনদীর অপূর্ব রূপ। অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত নদীতে পা ডুবিয়েই বসে থাকা যায়। রাতে নদীর উপর ঝুলে থাকা ব্যালকনিতে বসে চা-এর সঙ্গে পকোড়া খেতে খেতে আড্ডা জমতেই পারে।

কিন্তু আমরা পড়লাম অন্য বিপদে। ঝড়-বৃষ্টিতে ব্রিজ ভাঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তাই ঝুপুৎ করে অন্ধকার নামল চারদিকে। রাতের খাওয়ার ঘরে বসে মোমের আলোতেই সারতে হল। সেরেই দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরেই থাকলাম। একটু যে বুক দুরু দুরু করছিল না তা নয়। রাতে বেশ কয়েকবার মনে হল ব্যালকনি দিয়ে কারা যেন হাঁটাহাঁটি করছে। মানুষ না বন্য কেউ জানি না।

সকাল হতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। অপূর্ব সুন্দর লাগছে পাহাড় ঘেরা খরোস্রাতা ওই নদীকে। দু’দিনের বুকিং থাকলেও একদিনেই আমরা ঋষিখোলা ভ্রমণ শেষ করার পরিকল্পনা করলাম কারণ সেখানকার পরিস্থিতি। তবে মনে মনে একটা আফশোস থেকে গেল, এত সুন্দর জায়গাটাকে ভালমতো উপভোগ করতে না পারার জন্য। ফেরার অঙ্গীকার ছিল তবে এখনও সে কথা রাখতে পারিনি।

ফেরাটা অনেক মসৃণ হল, কারণ রাস্তা সম্পর্কে আসার সময়ই স্পষ্ট ধারণা হয়ে গিয়েছিল। রোদ ওঠানে পাহাড় থেকে নেমে রাস্তা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ঝর্ণাদের ক্ষমতা কিছুটা কমেছে। ফেরাটা অনেক কম সময়েই হল। ব্রিজের উপর এসে আবার সেই পুলিশ চৌকির দ্বারস্থ হলাম পরের গন্তব্যের জন্য। শুনে যদিও তাঁরা একটু চমকেছিলেন। তবে তাঁদের আশা ছিল আমরা যখন পাহাড়ের আল ধরে ঋষিখোলা পৌঁছতে পেরেছিলাম তখন এটাও পারব। তাই গাড়িটা তাঁরাই ডেকে দিয়েছিলেন।  পরের গন্তব্যের গল্প অন্য কোনওদিন বলব।

(বেড়ানোর আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)