‘‘সিংহ দ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে জানলাম সেখানে কোনও সিংহ নেই’’

সিংহ দ্বীপ

সিংহ দ্বীপ ভ্রমণ বাঙালির চেনা ছন্দের বাইরে বেরিয়ে কিছুটা দেখার চেষ্টার মতো। তবে লেখকের কাছে সুযোগটা এসে গিয়েছিল ওই দেশে থাকার সুবাদে। আর এমন সুযোগ ছাড়ার পাত্র নন তিনি মোটেও। তাই জমিয়ে ঘুরলেন তার সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নিলেন জাস্ট দুনিয়ার পাঠকদের জন্য। সিংহ দ্বীপ ভ্রমণ জয়ন্ত দত্তর কলমে


পাপুয়া নিউ গিনি-তে তখন আমি। সেটা ২০১৪-১৫ সাল। পাপুয়া ইউ গিনি এমন একটা দেশ যার ৭০ শতাংশ জায়গায় এখনও মানুষের পা -ই পড়েনি। প্রত্যেকটা উইকেন্ড অসামান্য কাটত। আজ তেমনই একটা সপ্তাহান্তের গল্প শোনাব। আবার ঠিক গল্পও নয়, আসলে শোনাব আমার অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথা। বাঙালির সিংহ দ্বীপ আসলে লায়ন আইল্যান্ড।

কার না ইচ্ছে হয়, যে শনি-রবিবার একটু ল্যাদ খাই! আমিও তার ব্যতিক্রম নই। প্রথমেই বলে রাখি, জায়গার নাম সিংহ দ্বীপ হলেও, এখানে কিন্তু একটাও সিংহ নেই। সিংহ কেন, এই দ্বীপে কোনও ভয়ঙ্কর জীবই নেই। আসলে এটা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একদম পুঁচকে একটা দ্বীপ— হেঁটে ঘুরলে ২০ মিনিটে শেষ হয়ে যায়। কেউ থাকে না এই দ্বীপে। আর দিনের বেশ কিছুটা সময়, মানে জোয়ার এলে ৬০ শতাংশ সমুদ্রের নীচে চলে যায়।

এখানে শুধু জেলেরা মাঝে মাঝে আসেন মাছ ধরতে বা বিশ্রাম নিতে। দ্বীপটা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটা সমতলভূমির মতো, তার চার পাশ খুব গভীর। স্ক্যুবার জন্য বিশ্বের অন্যতম ভাল জায়গা হল এই পাপুয়া নিউ গিনি। গ্রেট বাররিয়ার রিফে স্ক্যুবা করার পরেও আমি এটা লিখতে বাধ্য হলাম। অস্ট্রেলিয়া আর পাপুয়া নিউ গিনি গিয়ে সমুদ্রের নীচের জগৎকে খুব ভালবেসে ফেলে স্ক্যুবা ট্রেনিং করেছি। আর ১০ বারের বেশি সমুদ্রের নীচে ৮০ মিটার গভীরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার। ওই জগৎ তাই আলাদা, সে কথা আর এক দিন বলব।

যাই হোক আসল কথায় ফিরি! মনের এই দোষ, বার বার এ দিক ও দিকের কথা বেশি বলা হয়ে যায়। ওখানে আমরা যারা বিদেশিরা কাজে গিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে যাদের মাথায় খ্যাপামো ছিল আমার মতো, তারা মিলেই বেরিয়ে যেতাম উইকেন্ডের কোনও এক দিন।

পোর্ট মোর্সবি থেকে প্রায় ১ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটা জেলেদের গ্রামে যেতাম। তার পর ওদের বলে কয়ে একটা নৌকার বন্দোবস্ত করতাম। ওদের সঙ্গে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল বার বার যেতে যেতে। ওরা আমাদের ওয়ান্তক বলত। ওয়ান্তক মানে বন্ধু। কষ্টের মধ্যেও কী করে হাসিখুশি থাকতে হয়, সেটা ওদের না দেখলে বিশ্বাস হয় না। থাকার মতো ঠিকঠাক জায়গা নেই। ৫-৬টা পরিবার থাকে ঝুপড়ি করে, তার মধ্যেই সংসার। নিজেরা ছোট ডিঙি বানায় নারকেল গাছ খোদাই করে। মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে। কিন্তু ওদের কাউকে কোনও দিন বিষণ্ণ দেখিনি। আমরা লায়ন আইল্যান্ড যাব শুনে ওরা প্রথম দিকে আমাদের পাগল ভাবত! যে দ্বীপে কেউ থাকে না, সেখানে গিয়ে কী করব?

ভদ্রতা জিনিসটা ওদের থেকে শিখতে হয়। আর ওদের ভদ্রতা দেখে সত্যি লজ্জা লাগত। আমরা প্রতি বার যাওয়ার সময় ওখানে বাচ্চাদের জন্য চকোলেট, খেলার জন্য বল আর টুকটাক স্টেশনারি নিয়ে যেতাম। ওরা কিন্তু কোনও দিন আমাদের কাছ থেকে নৌকার ভাড়া নেয়নি। বলত যে, এটা তো ওদের ব্যবসা নয়। এটা যদি কোনও ফেরিঘাট হত তা হলে টাকা নিত। উল্টে আমরা যেগুলো নিয়ে যেতাম বাচ্চাদের জন্য সেগুলোর দাম দিতে চাইত। অনেক বলে কয়ে তার থেকে বিরত করতাম।

ওই দ্বীপের সময়টা কিন্তু আমাদের দারুণ কাটত। ভোরবেলা বেরিয়ে জেলেদের গ্রামে যেতে ১ ঘণ্টা লাগত। গাড়ি আমরা ওখানেই রেখে দিতাম তার পর ওদের সঙ্গেই আমরা ব্রেকফাস্ট করতাম। আমরা ব্রেড আর সসেজ নিয়ে যেতাম। আর ওদের ওখানে লাল আলু আগুনে ঝলসে সবাই মিলে দারুণ পিকনিক মত হত। এর পর নৌকায় ১ ঘণ্টা গিয়ে ওই দ্বীপে পৌঁছনো। আমাদের দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে ওরা চলে আসত।

আমরা থেকে যেতাম ছোট্ট দ্বীপটাতে। ঝকঝকে পরিষ্কার তুঁতে জল। খালি চোখে ৪-৫ মিটার দেখা যায়। দ্বীপের অনেকটাই অল্প জলের নীচে। ওখানে পৌঁছে একটু ঘোরাঘুরি করে তার পর সমুদ্রের মাঝে ক্যাম্প চেয়ার পেতে বসে আড্ডা দিতাম আর বিয়ার খেতাম। এর পর দ্বীপেে থাকা নারকেল গাছ দিয়ে বানানো ডিঙি নিয়ে নিজেরাই বেরোতাম মাছ ধরতে।

এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমরা কিন্তু এটা একটু ফাঁকিবাজি মেরে করতাম। প্রায় ২০০ মিটার লম্বা দড়ির এক দিক দ্বীপের কোনও একটা গাছে বেঁধে দিতাম। আর অন্য দিকটা ডিঙির সঙ্গে বেঁধে ডিঙি ভাসিয়ে দিতাম— যাতে প্রশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে না যাই। কারণ, আমাদের নিজেদের ডিঙি চালানোর দক্ষতা আমরা খুব ভাল করেই জানতাম!

কিন্তু ওই যে দুশো মিটার অবধি যাওয়া, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ, মাছ ধরার মজা, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। বেশ কয়েক ঘণ্টা চড়া রোদ্দুরে ডিঙিতে থেকে যখন মাছ ধরে ফিরতাম, তখন সকালের ব্রেকফাস্ট হজম হয়ে গিয়েছে। দ্বীপে পড়ে থাকা কাঠকুটো জ্বেলে, সদ্য ধরা মাছ আগুনে রোস্ট করতাম— আর সেটাই ছিল লাঞ্চ।

বিকেলে যখন সূর্য ঢলে আসার সময় হত, আমাদের ফেরার তোড়জোড় শুরু করতাম। ওরা এসে যেত আমাদের দ্বীপ থেকে ফেরত নিয়ে যেতে। ওদের গ্রামে ফিরলে কফি খাওয়াতো, আড্ডা হত, এর পর গাড়িতে ওঠার আগে একমুখ হাসি নিয়ে বলতো, ‘‘লুকিম যু বেহাইন ওয়ান্তক।’’ মানে, ‘‘আবার দেখা হবে বন্ধু।’’ আমরাও এক সপ্তাহের অক্সিজেন নিয়ে ফিরে আসতাম।

এখন যখন পুরনো দি‌নগুলোর কথা ভাবি, মনে হয়— আর কি কোনও দিন দেখা হবে? কে জানে।

(বেড়ানোর আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)