Cossimbazar Rajbari-তে একরাত, ছমছমে পরিবেশেও অনন্ত ভাললাগা

Cossimbazar Rajbari

সুচরিতা সেন চৌধুরী: বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০১৮-র ডিসেম্বর মাস। কলকাতায় তখন জাঁকিয়ে শীত। মুর্শিদাবাদের ঠান্ডাটা যে কলকাতা শহরকে ছাঁপিয়ে যাবে তা জানাই ছিল। তাতে কী, বেড়ানোর কোনও মরসুম নেই। কিন্তু মুর্শিদাবাদ তো আগেও গিয়েছে। একটু অন্যরকম কিছু ভাবতে হবে। কিছুদিন আগেই ফেসবুক সার্চ করতে করতে চোখে পড়েছিল কাশিমবাজার রাজবাড়ির (Cossimbazar Rajbari) কথা। সেখানে নাকি থাকা যায়। রাজবাড়িতে থাকার অনুভূতিটা হোটেলের থেকে যে আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কতটা ভাল হবে তখনও জানি না। খুঁজে পেতে পাওয়া গেল কাশিমবাজার রাজবাড়ি বুকিংয়ের হদিশ। কিছু না ভেবেই বুক করে ফেললাম।

রাজবাড়িতে থাকার উত্তেজনাতেই শিয়ালদহ থেকে বহরমপুরগামী ট্রেনে চেপে বসলাম সাত সকালে। শীতের সকাল তার উপর রাজবাড়ির টান। দ্রুতই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। শীতের সকালের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগেই। যদিও স্টেশন চত্তর ফাঁকা। সেখান থেকে রিক্সা করে পৌঁছে গেলাম রাজবাড়ির সামনে। ধবধবে সাদা রাজবাড়ি পাশের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে হল। সেই সময় ট্যুরিস্ট বলতে আমরাই। এখন শুনেছি সেখানে থ্রিস্টার ফেসিলিটি পাওয়া যায় কিন্তু তখন খুবই স্বাভাবিক ছিল। আর সেটাই দারুণ উপভোগ করেছিলাম।

রিসেপশনে সব ফর্মালিটিস সেরে ঢুকে পড়লাম রাজবাড়ির অন্দরে। প্রাচীন সব ঐতিহ্য ধরে রেখে কাশিমবাজার প্যালেস অফ রয়েস রাজবাড়ি। আমাদের ঘরের পাশেই রাখা রয়েছে সেই সময়ের একটি পালকি। বিশাল আয়নায় এসে পড়ছে রাজবাড়ির এক অংশের প্রতিচ্ছবি। দু’দিকে বিশাল লবির মাঝখানে আমাদের ঘর। একদিকের লবি সাজানো প্রাচীন কাঠের চেয়ার-টেবলে। সঙ্গে বেলজিয়ান গ্লাসের উপর সূর্যের আলো পড়ে তৈরি হয়েছে নান রঙের আঁকি-বুকি। ঘরে ব্যাগপত্তর ফেলেই বেরিয়ে পড়েছিলাম হাতের কাছের অংশগুলো দেখে নিতে। আমাদের ঘরের সামনেই একটা ছাদও চোখে পড়ল টপকে ঢুকে পড়লাম। সেখান থেকে একফ্রেমে ধরা পড়ছে রাজবাড়ির চত্তরের অনেকটা অংশ। দেখতে দেখতেই ডাক পড়ল ব্রেকফাস্টের। ঢুকেই অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম।

Cossimbazar Rajbari

রাজবাড়ির বারান্দায় বসেই সেরে নিলাম ব্রেকফাস্ট বাটার টোস্ট আর পোচ দিয়ে। সঙ্গে দারুণ দার্জিলিং চা। শেষ পর্যন্ত ঘরে ঢুকলাম বাইরের মোহ কাটিয়ে। সুন্দর সাজানো ঘর।  প্রায় মেঝে থেকেই সিলিং পর্যন্ত বিশাল বিশাল জানলা পুরো ঘর জুড়ে। পুরোটাই কাঠের। বোঝাই যাচ্ছে পুরনো স্থাপত্য নষ্ট না করেই সেটাকেই হোটেলের রূপ দেওয়া হয়েছে। শুধু রঙের প্রলেপ পড়েছে। প্রায় ভোররাতে উঠে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে বলে এতক্ষণে বেশ ক্লান্ত লাগছে। তাই স্নান করে একটু বিশ্রাম। বিকেলে বেরবো মুর্শিদাবাদ দর্শনে। সে জন্য রাজবাড়ি থেকেই গাড়ি বুক করে নেওয়া হল।

এখানে বলে রাখি, এখনও কিন্তু কাশিমবাজার রাজবাড়ির অন্দরমহল আমাদের দেখা হয়নি। রাজবাড়ির দেখভালের দায়িত্বে থাকা গোবিন্দ      অবশ্য একটা দারুণ আইডিয়া দিলেন। তিনি বললেন, ‘‘এখানেই তো থাকছেন তাহলে রাজবাড়ির ভিতরটা রাতে ঘুরতে ভাল লাগবে।’’ এমন অফার কে ছাড়ে। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই রাজি। বিকেলের আগেই মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। সেটাও দারুণ হল। সব থেকে ভাল লাগল মতিঝিলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। তবে মনের মধ্যে রাতের অন্ধকারে রাজবাড়ি দেখার উত্তেজনাটা টগবগ করে ফুটছে। হোটেলে ফিরতে ৯টা বেজে গেল। ভয়ে ছিলাম অত রাতে রাজবাড়ির ভিতর যদি ঢোকা না যায়? কিন্তু না, রাত গভীর করেই আমরা রাজবাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলাম। তার আগে ডিনার সেরে নিলাম। এর পর শুরু হল আমাদের অ্যাডভেঞ্চার।

Cossimbazar Rajbari

ঠাকুর দালান

গভীর রাতে কাশিমবাজার রাজবাড়ির ভিতর এক ঘণ্টা। একটা করে সামনের আলো জ্বলে উঠছিল আর চোখের সামনে খুলে যাচ্ছিল একটা আস্ত ইতিহাসের পাতা। গোবিন্দ পড়ছিল সে পাতা আর আমরা শুনছিলাম মুগ্ধ হয়ে। কাশিমবাজার রাজবাড়ি সেই সময় তৈরি হয়েছিল যখন মুর্শিদাবাদ বাংলার নবাবদের রাজধানী ছিল। গঙ্গার ধারে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসায়ীক গুরুত্বও অনেক বেশি ছিল কাশিমবাজারের। বন্দর শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তার পর নদীর দিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভাগ্যও পরিবর্তীত হয়ে যায় এই এলাকার। এই সব ভাবতে ভাবতেই কোথায় যেন ঢংঢং করে রাত ১২টার ঘণ্টা বেজে উঠল।

গোবিন্দ বলে চলেছেন। একটা করে সামনের আলো জ্বালাচ্ছে আর পিছনের আলো বন্ধ করে দিচ্ছে। যেন আলোগুলো আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলছে। সেন্ট্রাল বল রুম দারুণভাবে সাজানো প্রাচীন ঝাড়বাতি, পেইন্টিং, বিশাল বিশাল আয়নায়। ঘর জুড়ে রয়েছে সব ভিক্টোরিয়ান যুগের আসবাব। রয়েছে পাঁচটি বিশাল খিলানসহ হল, যেটা ছিল কোর্টরুম। শোয়ার ঘরে সেই প্রাচীনকালের চারদিকে কাঠের লম্বা লম্বা স্ট্যান্ড দেওয়া খাট, প্রাচীন ড্রেসিংটেবল। আর মাথার উপর ঝুলছে হাতে টানা পাখা। সব বন্ধ, কোথাও কোনও হাওয়া নেই তাও ও দুলে চলেছে। যেন বাতাস করে চলেছে কয়েকশো বছর ধরে একইভাবে।

Cossimbazar Rajbari

বাথরুমের বাথটাবে মরচে ধরেছে। দুর্গা দালান সুনসান। পুজোর সময় এই জায়গাটাই জমজমায় হয়ে ওঠে। প্রতিবছর পরিবারের যে যেখানে রয়েছেন সেখান থেকে এখানে একত্রিত হন। ইতিহাস যেন সেই সময় জেগে ওঠে বর্তমানের মোরকে। দুর্গাদালানে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। হঠাৎ সম্বিত ফিরতে দেখি গোবিন্দ নেই। ডেকেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছেন না। খুব বেশি না হলেও বুকের ভিতরটা ধুকপুক করেনি বললে ভুল হবে। বেশকিছুক্ষণ হাক ডাকের পর হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন তিনি। আমাদের স্বস্তি ফিরল। জানালেন, সব দরজা বন্ধ করতে গিয়েছিলেন। মনে মনে ভাবলাম, এমন কেউ করে? তবে ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারছিলাম, মহলের ভিতরের ভূগোল না জানা লোককে ছেড়ে দিলে সে হারিয়ে যেতে বাধ্য।

রাজবাড়ির রান্নাঘরের পাশেই রয়েছে এখনকার রান্নাঘর। দুটোর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। প্রাচীন রান্নাঘরে কোনও কাজ হয় না। তবে মাটির উনুনের জায়গাগুলো রয়ে গিয়েছে এখনও। প্রাসাদের একতলা, দোতলা জুড়ে রয়েছে শুধুই ইতিহাস আর গা ছমছমে অনুভূতি। এ প্রাসাদে ভূত আছে বলে শুনিনি। আমাদের তেমন কোনও অভিজ্ঞাও হয়নি। যেটা হয়েছে সেটা হল, সেখানকার স্টাফদের অসাধারণ ব্যবহার। অনেক বন্ধ দরজার ভিতরের প্রশ্নগুলো থেকেই গিয়েছে উত্তরের অপেক্ষায়। আমরাও জানতে চাইনি। গভীররাতে রাজবাড়ির অন্দরে ঘুরে বেড়ানোর কথা ভাবলে এখন বেশ শিউড়ে উঠি তখন কিন্তু তেমন লাগেনি। তবে সব রাজবাড়ির মতই কাশিমবাজার রাজবাড়ির অন্দরেও লুকিয়ে রয়েছে অনেক গল্পগাথা, যা সবার জন্য নয়।

Cossimbazar Rajbari

ছবি: লেখক

(বেড়ানোর আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)