Way To Manali: বৃষ্টি, ধসে অল্পের জন্য রক্ষা, চতুর্থ পর্ব

Way To Manali

সুচরিতা সেন চৌধুরী: একে তো বৃষ্টি। সঙ্গে মানালির রাস্তায় মাঝে মাঝেই ধস নামছে তাই ভোর ভোর বেরিয়ে পড়তে হবে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল গাড়ির চালক। হোটেল থেকেও বলে দিয়েছিল রাস্তায় সময় নষ্ট করতে না। এমনিতেই শিমলা থেকে মানালি অনেকটা রাস্তা (Way To Manali)। প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার। যে রাস্তায় খুব স্বাভাবিকভাবেই পৌঁছতে লেগে যায় ৭-৮ ঘণ্টা। বৃষ্টিতে সেটা কতক্ষণে গিয়ে পৌঁছবে কেউ জানে না। এক কথায় এই আবহাওয়ায় অজানার উদ্দেশেই বেরিয়ে পড়া। শিমলা ছাড়তে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। এক ছুটে ম্যালকে ছুঁয়ে এলাম। এদিনও দেখলাম মেঘ নেমেছে ম্যাল জুড়ে। কিন্তু মিনিট খানেক কাটিয়েই ফিরতে হল। গাড়ি ছাড়ল ভোর ভোর। শিমলাকে বিদায় জানালাম। মানালির আকর্ষণ তো রয়েছেই। সঙ্গে রয়েছে রাস্তার আতঙ্কও।

রাস্তার দু’ধারে সবুজের সমারোহ। মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। পথে খুব সুন্দর কিছু দেখলেও নামবো না ঠিক করেছি। সময় নষ্ট করা যাবে না চালকও জানিয়ে দিয়েছেন। মাঝে একবার শুধু লাঞ্চ করার জন্যই দাঁড়ালাম সুন্দর একটা ভ্যালি মতো জায়গায়। লাঞ্চ সেরেই আবার চলল গাড়ি। কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হল খারাপ রাস্তা। গাড়ির চালক জানালেন, বৃষ্টি এই রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। পুরোটাই এখন এমনই। স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির গতি কমে এল। তার মধ্যেই যতটা সম্ভব চেষ্টা করছিল আশপাশের প্রকৃতিতে ক্যামেরাবন্দি করতে। মনের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্কও রয়েছে, মানালি পৌঁছনো নিয়ে। ভাবতে ভাবতে ঝুপুৎ করে কোথা থেকে চলে এল বৃষ্টি।

এখানে বলে রাখা ভাল, এদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভাড়। তবে এতক্ষণ বৃষ্টি ছিল না। জানলা বন্ধ করতেই হল। শিরশিরানি ঠান্ডাটাও জানলার ফাঁক গলে ঢুকে আসছে। মন্দ লাগছে না। পাহাড়ে বৃষ্টি তো আমার সব সময়ই প্রিয়। কিন্তু এই যে ধসের আতঙ্ক একটা থেকেই যায়। বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বাড়ছে। আর মন্থর হচ্ছে গাড়ির গতি। কখনও কখনও সামনের রাস্তা পুরো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চালককে দেখছি শুধু আইডিয়ার উপর গাড়ি চালাচ্ছেন। পুরো রাস্তাটাই এভাবে চলতে চলতে কখন যেন হঠাৎ করে বিকেল নেমে এল মানালির পথে। চালকও ক্লান্ত। বললেন কুলু পৌঁছে গিয়েছি। এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে তার পর আবার যাবো।

Way To Manali

আগেই বলেছি হিমাচলের যে দিকেই চোখ পড়বে অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতি। আর বর্ষাকাল হওয়ায় সবুজ আর গাঢ় হয়েছে। কিন্তু যেখানে গাড়ি আমাদের দাঁড়ায় সেখানে গাড়ি থেকে নেমে চোখ জুড়িয়ে গেল। রাস্তার পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে বিয়াস বা বিপাশা নদী। আমার অন্যতম প্রিয় নদী। এক নম্বরে অবশ্যই তিস্তা। কারণ জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবই ওই তিস্তার পাড়ের গ্রামে। দ্বিতীয় স্থানে মুহূর্তে জায়গা করে নিল বিয়াস। সামনেই ছোট ছোট চা, স্ন্যাক্সের দোকান। অর্ডার দিয়ে সোজা নেমে গেলাম নদীর পাড়ে। চালক জানালো আমরা কুলুতে ঢুকে পড়েছি। কুলু ভাল লেগে গেল মুহূর্তে। থাকার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু নদীর ধারের হোটেল বিয়াসের আকর্ষণ উপেক্ষা করা গেল না। কিন্তু সেটা হবে ফেরার পথে কারণ মানালি হোটেল বুকিং হয়ে গিয়েছে তিন দিনের।

বিয়াসের ধারে পাথরের উপর বসে চা আর স্ন্যাক্সের মজা লিখে বোঝানো মুশকিল। ওটা শুধু অনুভব করতে হয়। জলে পা দিয়ে পা পুরো জমে গেল। এতটাই ঠান্ডা সে জল ও এখানে একটা মজার জিনিস রয়েছে নদী পাড়াপাড়ের জন্য দড়ি দিয়ে টানা রোপওয়ে। স্থানীয় মানুষ এভাবেই নদী পাড় হন। আমরাও সেই অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিলাম। সত্যিই অ্যাডভেঞ্চারই বটে। চা শেষ করেই আবার চলার শুরু। পথে হোটেল বিয়াসে কথা বলে গেলাম ফেরার পথে একরাত ওখানে থাকব। কুলু থেকে মানালির পথ খুব বেশি নয়। ১ ঘণ্টা লাগার কথা। বড়জোড় রাস্তা খারাপ হওয়া সেটা ২ ঘণ্টা হতে পারে। কিন্তু এই পথেই আমাদের কেটে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কতক্ষণ আটকে ছিলাম আজ আর সত্যিই মনে নেই। আসল অ্যাডভেঞ্চার যে শেষ ৪১ কিলোমিটার রাস্তায় অপেক্ষা করছিল তা কে জানত।

কুলু থেকে বেরতেই সন্ধে হয়ে এসেছিল। কিন্তু ভেবেছিলাম পৌঁছেই তো গেছি প্রায় তাই আর চিন্তা নেই। কুলু থেকে যখন গাড়ি ছাড়ল তখন ছিটেফোটা বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। মাঝে খানিকটা রোদেরও দেখা পাওয়া গিয়েছিল। আসলে এটাই পাহাড়ের সৌন্দর্য। যাক সেই বৃষ্টি ক্রমশ ভয়ঙ্কর আকাড় নিল। একটা সময় আর গাড়ি চালানো যাচ্ছিল না। পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলেন চালক। তিনি জানালেন এই পথে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরাও সায় দিলাম। গাড়ির মধ্যেই গরম পোষাক চাপিয়ে বসে থাকলাম। অপেক্ষা কখন বৃষ্টি একটু কমবে। কিন্তু কোথায় কী, কমা তো দূরঅস্ত, ক্রমশ তা বেড়েই চলেছে। ত্রিসীমানায় আর কিছু নেই। ওই পথে একটিও গাড়ি চলছে না। ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম, তখন পাহাড়ে অফ সিজন ছিল। ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। ততক্ষণে রাত নেমেছে পাহাড়ের বুকে।

কিছুক্ষণ পর মনে হল বৃষ্টি একটু কমেছে। চালক বললেই চেষ্টা করি এগনোর। না হলে আজ সারারাত এখানেই আটকে থাকতে হবে। আমরা সব সিদ্ধান্তই ছেড়ে দিয়েছিলাম গাড়ির চালকের হাতে। আতঙ্ক একটা ছিলই, এই বৃষ্টিতে জল ঢুকে কোনওভাবে যদি গাড়ির ইঞ্জিন অকেজ হয়ে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে। কিন্তু দেখা গেল না গাড়ি স্টার্ট নিল। খুব মন্থর গতিতে আমরা এগোতে থাকলাম। বৃষ্টি বিরামহীন। ওই ভাবে কতটা এগিয়েছিল জানি না। ঘণ্টাখানেক পর দূরে একটা আলো চোখে পড়ল। চালক জানালেন ওটা স্থানীয় কারও বাড়ি। কারণ হোটেল হলে রাতটা ওখানেই কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু সে উপায় নেই। বৃষ্টি আবার বাড়ছে বোঝাই যাচ্ছে। সামনেটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির হেড লাইটের আলোতে ২-৩ ফিটের বেশি নজর যাচ্ছে না। এর মধ্যেই সামনে থেকে স্বয়ং মৃত্যুকে দেখলাম আমরা।

Way To Manali

হিমাচলের বিভিন্ন রাস্তায় এমনটা দেখা যায়, পাহাড়ের গা থেকে ঝুলে রয়েছে বিশালাকার পাথরের চাই। তার নিচ দিয়েই নিশ্চিন্তে গলে যায় গাড়ি। এদিন যে বিষয়টা এমন ছিল না টের পেলাম। তেমনই একটা পাথর সামনে চোখে পড়ল। বুঝতে পারলাম ওটার নিচ দিয়ে গলে যাবে গাড়ি। রাস্তা ভেঙে পাথুরে আর মাটির হয়ে গিয়েছে। পুরোটাই লাফাতে লাফাতে চলছে। ওই পাথরের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময়ও একবার গাড়ির ছাদ ঠুকে গেল পাথরের গায়ে। কিন্তু পেরিয়ে গেলাম জায়গাটা। খুব বেশি দূর যাইনি, পিছন ফিরলে ওই পাথরটাকে দেখা যাবে। এমন সময়ই বিভৎস একটা শব্দ, যেন কিছু হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে। আঁৎকে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে হৃদপিণ্ড যেন কাজ করা বন্ধ করে দিল। ঠিক মিনিট পাঁচের আগে যে পাথরটা পেরিয়ে এলাম সেটা পাহাড়ের একটা বড় অংশ নিয়ে ভেঙে পড়েছে। তখনও ভাঙছে। রাস্তা পুরো বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।  সবাই অবাক হয়ে পিছনেই তাকিয়ে রয়েছি আর ভাবছি কী বরাত জোড়ে এই প্রাণ বেঁচে যাওয়া।

চালক বললেন, আর দাঁড়ানো যাবে না। এবার যে ভাবেই হোক পৌঁছতে হবে। ‌না হলে আরও বড় বিপদ হতে পারে। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের পাথরের নিচের মাটি হালকা হয়ে গিয়ে এমন আরও হবে। কুলু থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন বিকেল ৪টে হবে ঘড়িতে। এতক্ষণ পরে হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ গেল। বুঝতেই পাড়িনি ১ ঘণ্টার রাস্তা ৫ ঘণ্টা কেটে গেলেও আমরা পৌঁছতে পারিনি। চালক বললেন, অনেকটাই কাছে এসে গেছি। কোনওরকমে পৌঁছতে পারলে হয়। কিছুক্ষণ পড়ে ছোট ছোট বেশ কিছু আলো চোখে পড়ল। যেন কিছুটা ভরসা পেলাম। জানা গেল মানালি ঢুকে গিয়েছি। কিন্তু গোটা পাহাড়ি শহর তখন ঘরে ঢুকে পড়েছে। রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। ভাগ্যিস চালক হোটেলটা চিনতেন না হলে সে সময় তো গুগল ম্যাপও ছিল না।

হোটেলের সামনে যখন পৌঁছলাম ঘড়ির কাটায় তখন রাত সাড়ে ১০টা। হোটেল পুরো বন্ধ। অনেক হাঁকডাকের পর খোলানো গেল। ওরা ভেবেছিল আমরা আজ আর পৌঁছতে পারব না। সবই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবারও নেই। তাহলে উপায়, এদিকে পেটে চুহা দৌঁড়চ্ছে। গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পরদিন সকালে রোটাংপাস যাওয়ার প্ল্যান। তাই অন্য কোথাও খাবার খোঁজ করারও উপায় নেই। ওদের জিজ্ঞেস করলাম ডিম আছে কিনা? বলল আছে। ওদের বললাম, ভাত আর ডিম সেদ্ধ করে দিয়ে দিতে। ওদের দয়া হল আমাদের দেখে তাই সঙ্গে ডাল সেদ্ধও দিয়ে গেল। সবাই চূড়ান্ত ক্লান্ত, শারীরিক ক্লান্তির উপর চেপে বসেছে মানসিক ক্লান্তি। তাই ঘুম আসতে দেড়ি হল না। যতক্ষণ জেগে ছিলাম প্রবল বৃষ্টির শব্দ পেয়েছি।

ছবি—লেখক ও সংগৃহিত

(চতুর্থ পর্ব)

Shimla Sightseeing: ঘোরার পিঠে পাহাড়ি পাকদণ্ডী, তৃতীয় পর্ব

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle