প্রথম নৈনিতাল দেখার সঙ্গে প্রেমে পড়েছিলাম মেঘ-বৃষ্টির, দ্বিতীয় পর্ব

প্রথম নৈনিতাল

প্রথম নৈনিতাল দেখার অভিজ্ঞতা তাও আবার রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার, বাড়ি থেকে লুকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়া। ট্রেন জার্নি, ক্লান্তি, বৃষ্টি, হোটেল বদল—সব মুহূর্তে কীভাবে বদলে দিতে পারে পাহাড়ের বদলাতে থাকা আবহাওয়া, সেই অভিজ্ঞতার কথাই লিখছেন সুচরিতা সেন চৌধুরী, আজ দ্বিতীয় পর্ব।


দ্বিতীয় ভোরটা হল প্রবল বৃষ্টির মধ্যে। শহুরে সকালে ঘুম না ভাঙলেও পাহাড়ি সকাল এমনিই ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। সকালের পাহাড়টায় অদ্ভুত একটা মায়ার চাদর জড়িয়ে থাকে। যা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে আসতে কেটে রোমান্টিক হয়ে ওঠে। এই দুটো সময়ের বদল আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। ঠিক যেভাবে আমি মেঘের গন্ধ পাই। আজ বৃষ্টির জন্য মেঘগুলো কেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ছে। মাঝে মাঝে আমার হোটেলের ঘরের কাঁচের জানলায় উঁকি দিয়েই উড়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকবার হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম কিন্তু ধরা দিল না।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বন্ধ হল। ততক্ষণে ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে গোটা নৈনিতাল। লেকের জল কী বৃষ্টির জন্য অনেকটা বেড়ে গিয়েছে? কী জানি এমন হয় কি? বৃষ্টিতে নদীতে জল বাড়তে দেখেছি, লেকেও কি বাড়ে? বৃষ্টি কমতেই অবশ্য লেকের জলে নানা রঙের নৌকো নেমে পড়েছে হইহই করে। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। ও এই সকালেই গরম গরম চায়ের সঙ্গে গোলাপ ফুল এসেছে আমার জন্য। সকালে আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্টও খাইয়েছেন উনি।

হোটেল থেকে বেরিয়ে সোজা লেকের ধার। সুন্দর রেলিং দিয়ে ঘেরা পুরো লেকটা। সেখানে দাঁড়িয়েই সময় কেটে যায়। আপাতত পাহাড়ে রোমান্টিক টাইম। রেলিংয়ের ধার ধরে দাঁড়িয়ে কোনও হানিমুন কাপল, কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা। এই পরিবেশে ঝগড়া, রাগ থাকলেও সব নিমেশে উধাও হয়ে যাবে। একটা বেশ কনকনে হাওয়া মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওই প্রথম পরিষ্কার আকাশে সাদা মেঘেদের জটলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। নৈনিলেকের জলে ভাসতে ভাসতে ওই মেঘই দেখেছি সারাক্ষণ। মেঘের দলের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল নীল আকাশ। এই অনুভূতিটা বা দৃশ্যটা লিখে বোঝানো যাবে না।

প্রায় দু’ক্ষেপে দু’ঘণ্টা নৌকো ভ্রমণ করেছিলাম সেদিন আমরা। এতটাই ভাল লেগেছিল। লেকের একপাশে যেমন ঝাঁচকচকে নৈনিতাল শহর তেমনই উল্টোদিকে শান্ত জঙ্গল আর সেদিকেই নয়না দেবীর মন্দির। কথায় আছে দূর্গার চোখ পড়েছিল এখানে। সব পাহাড়ি মন্দির যেমন হয় এটাও তেমন তবে অপূর্ব সুন্দর পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই মন্দির। ঘণ্টার টুংটাং শব্দ পাহাড়ি পরিবেশে এক অন্য ছন্দ তৈরি করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। ঠাকুর ভক্তরা প্রাণভড়ে পুজো দেন এখানে। লোকে বলে জাগ্রত মন্দির। আমার কাছে জাগ্রত প্রকৃতি। আমি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে প্রকৃতির আরাধনা করে চলেছি।

মেঘ নেমেছে নৈনি লেকে

নয়না দেবীর মন্দির থেকে আবার লেকের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বাজারের মধ্যে। এখানে বলে রাখা ভাল নৈনিতালে এলে এখানকার বিখ্যাত মোমের জিনিস কিনবেনই। মোম দিয়ে তৈরি নানা অবয়ব। ছোট থেকে বড় নানা ধরনের পুতুল। সব দোকানে লাইন দিয়ে সাজানো মোমের পুতুল। এর মধ্যেই মাঝে ছিটে ফোটা বৃষ্টি ফিরে ফিরে আসছে। নৌকোয় ঘুরতে ঘুরতেও বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলাম। না, ছাতা খুলতে ইচ্ছে করেনি। মন্দ লাগছিল না ভিজতে। তবে বৃষ্টির তেজ বাড়েনি এটাই যা স্বস্তি। প্রবল বৃষ্টির সময়ও অনেককে দেখেছি বোটিং করছে।

লাঞ্চ বাইরেই সেরে নিয়েছি বাজারের এক রেস্টুরেন্টে। বিকেল হয়ে এসেছে। নৈনিতালের রোমান্টিক পরিবেশ বদলাতে শুরু করেছে। আর একটু পরেই বিকেল নেমে আসবে লেকের শহরে। গোটা নৈনিতালকে ঘিরে ধরবে আবেগ। যে আবেগ হেঁটে বেড়াবে লেকের ধার ধরে হাতে হাত রেখে শক্ত করে ধরে। বিকেলটা আমার জীবনে সব সময়ই আবেগী। সে কলকাতার গঙ্গার ঘাট হোক বা নৈনিলেকের ধার, বাড়ির ছাদও হতে পারে। ধিরে ধিরে দিনের আলো কেটে রাতের অন্ধকার নামার মাঝে শুধুই জড়িয়ে থাকে এক রাশ ইমোশন। সেই ইমোশনকে সঙ্গে করেই হোটেলে ফিরলাম।

একটু বিশ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে সবার পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ঘোরার সময় খেয়াল থাকে না। বসলেই টের পাওয়া যায়। হটশট ক্যামেরার রোলও শেষ। নতুন লাগাতে হবে। হাওড়া স্টেশন থেকে কিনেছিলাম প্রথমটা। দ্বিতীয়টা নৈনিতাল থেকে। ব্যাটারিও জবাব দিয়েছে। চার্জ করতে হবে। সব মিলে ফিরতেই হতো ঘরে। আমার পাহাড়ে ঘরে বসে থাকতেও মন্দ লাগে না। লোকজন অবশ্য তা নিয়ে আমার পিছনে কম লাগে না। কিন্তু ভাললাগা তো ভাললাগাই। আবার বৃষ্টি এল। আমাদের যদিও কোনও বিরক্তি নেই। জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে জমিয়ে গরম গরম কফি, মান্না দে আর আড্ডা চলল অনেকক্ষণ।

রাতের নৈনিতাল

অন্ধকার গাঢ় হতেই চোখের সামনে খুলে গেল এক স্বর্গীয় দৃশ্য। যেন সোনার গয়নায় সাজানো হয়েছে পুরো লেকটাকে। নাকি নৈনিতাল শহরের গলায় লেকলেস পরানো হয়েছে। লেকের ধার ধরে জ্বলে উঠেছে নানা রঙের আলো। পাহাড়ের রাতটা আসলে উদ্‌যাপনের, উৎসবের, অ্যাডভেঞ্চারের, প্রেমের। পাহাড়ের রাত হল জীবনের। বৃষ্টি কমেছে। ছাদে চেয়ার পেতে বসে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। উপভোগ করতে ইচ্ছে করে জীবনের ছন্দ। সোয়েটারের উপর চাদর চাপাতে হয়। ঠান্ডা বাড়ছে। নিজেকেই জড়িয়ে নিই আষ্টেপৃষ্ঠে।

পিছন থেকে শুনতে পাই, ‘‘ডিনার মে ক্যায়া দু ম্যাডাম?’’

(তৃতীয় পর্ব আগামী কাল)

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)