ভরা বর্ষায় লুলুং

ভরা বর্ষায় লুলুং যাওয়ার জন্যভরা বর্ষায় লুলুং যাওয়ার জন্য

শৌনক ত্রিপাঠী


ভরা বর্ষায় লুলুং যাওয়ার জন্য গভীর রাতের পুরী প্যাসেঞ্জার একে একে পিছনে ফেলে চলেছে চেনা চেনা নামের স্টেশনগুলো! বাইরে অঝোর ধারাপাত! মনে পড়ল, কলকাতা ছাড়ার আগে নিম্নচাপের ‘নিয়ম মেনে’ ওডিশা উপকূলের সরে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনে এসেছিলাম। তাতে খুব একটা গ্রাহ্য করিনি। আসলে ভরা বর্ষার লুলুং! খরস্রোতা সেই পলপলা! তার আকর্ষণ যে বড়ই তীব্র।

ভোররাতের জোলো-ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমটা গাঢ় হয়ে এসেছিল। ভাঙল, টিম লিডার শোভনদার ডাকে। আমাদের পাঁচজনের দলটাকে বৃষ্টিভেজা রূপসা জংশনে নামিয়ে দিয়ে ট্রেন যখন চলে গেল, ঘড়ির কাঁটায় পৌনে ছ’টা হলেও আকাশের ঘন, কালো কিউমুলো নিম্বাসের আড়াল ছিঁড়ে আলোর ছটা ফুটতে পারেনি তেমন। গরম চা আর ছানাপোড়ার টুকরোয় মনোনিবেশের মধ্যেই রূপসা-ভঞ্জপুর প্যাসেঞ্জার ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এল। ফের ঘন্টাখানেকের ঘুম-সফর শেষ হল ময়ূরভঞ্জ জেলার সদর বারিপদায়।

স্টেশনের বাইরে রাখা সেই আদ্যিকালের স্টিম ইঞ্জিনের অদূরেই সন্তোষের সেই পরিচিত অটো! ইতিউতি নজর ঘোরাতে ঘোরাতেই কানে পরিচিত গলায় ‘দাদা’ ডাক। এক বছর পরে আবার সেই পরিচিত পথে। বুড়িবালাম নদীর ব্রিজ পেরিয়ে অস্তিয়া মোড় হয়ে ডানদিকে ঘুরেছে পথ। বারিপদা থেকে সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান তথা ব্যাঘ্রপ্রকল্পের অন্যতম প্রবেশদ্বার পিথাবাটা ১৮ কিলোমিটার পথ। পিথাবাটা গেটের ঠিক আগেই বাঁ’দিকের পথ গিয়েছে দেড় কিলোমিটার দূরের সীতাকুণ্ড জলপ্রপাতের দিকে।

বেড়ানোর নানা স্বাদ পেতে ক্লিক করুন

গতবারে আমরা ছিলাম ঝর্না লাগোয়া চমৎকার একটা ঘরে। কিন্তু ব্লক পঞ্চায়েতের সেই গেস্ট হাউস আপাতত সংস্কারের জন্য বন্ধ। অগত্যা ফের ফিরে চলা ফরেস্ট গেটে। সেখানে পৌঁছে এক বনকর্মীর থেকে আশার আলোর সন্ধান মিলল। গেট দিয়ে ঢুকে পঞ্চাশ মিটার এগিয়েই ডানদিকে একফালি বেসরকারি জমিতে গড়ে উঠেছে একটি খামার বাড়ি। ভিতরে দু’টি ঘর পর্যটকেদের জন্য বরাদ্দ। বারিপদার এক দম্পতি সেটি ‘লিজ’ নিয়েছেন।

ভরা বর্ষায় লুলুং যাওয়ার জন্য

দু’দিন পরে সন্তোষকে ফিরে আসতে বলে আমরা সেঁধিয়ে গেলাম ঘর দু’টোতে। কোনওমতে মালপত্র রেখেই ক্যামেরা-বাইনোকুলার নিয়ে পদব্রজে জঙ্গল অভিযানে। লক্ষ্য, সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের লুলুং। কিন্তু দেড়শ মিটার গিয়ে পলপলা নদীর ব্রিজের সামনে গিয়েই থমকানোর পালা। রাতভর বৃষ্টিতে পাগলপারা পলপলা এখন সেতুর উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে। কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাকে জল ঠেলে এপারে আসতে দেখে মন থেকে হড়পা বানের আশঙ্কা দূর হল।

সেতুর ওপারে পথ দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। ডানদিকে, ভজাম চেকপোস্ট হয়ে সিমলিপালের অন্দরে। বাঁদিকের পথ নদী ঘেঁষে চলেছে লুলুং গ্রামের পানে। গ্রাম ছাড়িয়ে কয়েকশো মিটার এগোলে পলপলার ধারে ওড়িশা পর্যটন বিভাগের সেই অরণ্যনিবাস একদশক বন্ধ থাকার পরে ফের চালু হয়েছে। তবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ভোলবদলে এখন ঝাঁ-চকচকে। কাচে ঘেরা ডাইনিং হল আর সুইমিং পুল যেন এই জঙ্গুলে আবহে কিছুটা বেমানান। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দুজনের রাত্রিবাসের খরচ হাজার চারেক!

লুলুং থেকে পলপলার পাড় ধরে পায়ে হেঁটে আরও কিলোমিটার খানেক দূরের ফরেস্ট ক্যাম্প পর্যন্ত এগোনো যায়। সিমলিপালের বাফার অঞ্চলের এই বনভূমিতে হাতির যাতায়াত নিয়মিত। পথের ধারে পড়ে থাকা পূরীষ গজরাজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পাখি দেখিয়েদের কাছে জায়গাটি সত্যিই স্বর্গ! স্কারলেট মিনিভেট, লার্জ উডশ্রাইক, ক্রেস্টেড ট্রি সুইফট, গ্রিন বিলড মালকোহা, বেয়ার্ডেড বি ইটার, জঙ্গল আউলেট, ব্রাউন হেডেড বারবেট আরও কত কী!

ভারতের ক্ষুদ্রতম টিয়া, ‘ভারনাল হ্যাঙ্গিং প্যারটে’র ছোট ঝাঁকও চোখে পড়ল বারকয়েক। বহেড়া গাছের মগডালে নজরে এল ফুট-দু’য়েক লম্বা কাঠবেড়ালি, মালাবার জায়েন্ট স্কুইরেল। দিনের আলো ঢলে আসায় আমরা আবার ফেরার পথ ধরি। ঘন্টাচারেকের অনাবৃষ্টি তখন আবার সেতুর নীচে পাঠিয়ে দিয়েছে পলপলাকে।

ভরা বর্ষায় লুলুং

সুলুক-সন্ধান

• সীতাকুণ্ড-পিথাবাটা-লুলুং যাওয়া যায় বছরভরই। কিন্তু সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের অন্দরে ১৬ জুন-৩১ জুলাই বর্ষার জন্য ‘প্রবেশ নিষেধ’!• পিথাবাটা গেট দিয়ে গাড়ি নিয়ে শুধুমাত্র লুলুং যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢুকলে নাম-ধাম লেখালেই হবে। কোনও প্রবেশমূল্য দিতে হবে না। কিন্তু জোরান্ডা-বরাহাইপানি-চাহালা যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ‘ফি’ রয়েছে।
• বাবুঘাট থেকে বারিপদা যাওয়ার বেশ কযেকটি বাস আছে, ৬ ঘণ্টা মতো লাগে

ভরা বর্ষায় লুলুংসন্তোষের যোগাযোগের নম্বর—০৯৪৩৮৬৯০৭৭৮
পিথাবাটার গেটে ফার্ম হাউসের বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ— ০৯০০৭৪৩৭৭৩১
লুলুং অরণ্যনিবাস বুকিং— ০৮৪৮০২৭৬৭৩৭ এবং ০৭৯০৬৭৩২৫৭২