Kullu মানেই বিয়াসের বয়ে যাওয়া, আর গ্রামের পথে হাঁটা, শেষ পর্ব

Kulluকুলুতে বিয়াস নদী

সুচরিতা সেন চৌধুরী: পাহাড়ে গিয়ে গ্রামের পথে হাঁটতে না পারলে মনটা ভড়ে না। এই সফরে এটা পেয়েছিলাম কুলুতে (Kullu)। শিমলা থেকে মানালি যাওয়ার পথেই বলেছিলাম, বিয়াসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম প্রথম দেখাতেই। তাই তাঁর পাশে একটা দিন তো থাকতেই হত। মানালিতে বিয়াস আছে কিন্তু কুলুতে (Kullu)) বিয়াসকে যেভাবে আপন করে পাওয়া যায় তেমনটা নয়। তাই পরিকল্পনা না থাকলেও কুলুতে যে থাকতেই হবে সেটা সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম। গাড়ির চালক একটু বিরক্ত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আমরা মরিয়া ছিলাম। এক তো বিয়াসের আকর্ষণ উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। আর যাওয়ার দিনই চোখে পড়েছিল হোটেল বিয়াস, একদম রাস্তার উপর। আর ঘরে ঢুকে উল্টোদিকের বারান্দায় দাঁড়ালেই হাতের নাগালে সেই বিয়াস। তাই একদিন কুলুতে রাত্রীযাপন।

মানালি থেকে কুলুর দূরত্বের কথা তো আগেই জানিয়েছিলাম। আগের রাতে বৃষ্টি হলেও এদিন ঝকঝকে রোদ। মৃদু হাওয়া বইছে তাতে একটা কনকনে শীতের আমেজ। বৃষ্টির পর রোদ উঠলে পাহাড় যেন আরও রোমান্টিক হয়ে ওঠে। মানালি আজ ঠিক তেমনই। বরফ শৃঙ্কগুলোতে রোদ পড়ে চকচক করছে। কিন্তু আজ আমাদের মানালিকে বিদায় জানানোর পালা। ঘণ্টা খানেকের পথ তাই একটু সময় নিয়েই বেরোলাম। দুপুরের মধ্যে পৌঁছে কুলুতে গিয়েই লাঞ্চ করব ঠিক হল।মানালির হোটেলকে বিদায় জানালাম, বিদায় জানালাম রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা আপেলের দলকে। বিদায় জানালাম ভয়ঙ্কর রাস্তার অভিজ্ঞতাকে। এবার অনেকটাই নেমে যাওয়ার পালা। কুলুর উচ্চতা মাত্র ৪,১৯৬ ফিট। মানালির থেকে ১ ঘণ্টায় দুম করে অনেকটা নেমে যাওয়া।

এই পথের সৌন্দর্য যাওয়ার দিন তেমনভাবে উপভোগ করা হয়নি। এক তো বৃষ্টি ছিল তার উপর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আর তার পরটা তো ইতিহাস বেঁচে ফেরার। তাই আজ মন ভড়ে দেখব বলেই সামনের সিটটা দখল করেছিলাম। বেড়াতে গেলে আমার সব সময়ই পছন্দ গাড়ির চালকের পাশের সিট। সামনে, পাশে দু’ভাবেই পাহাড়কে দেখা যায়। পুরো রাস্তাটাই বিয়াস প্রায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল। কোথাও সে খরস্রোতা আবার কোথাও শান্ত সবুজ জল। এমন অনেক জায়গাই চোখে পড়ল যেখানে সটান নেমে যাওয়া যায় একদম বিয়াসের পাড়ে। কিন্তু সেই উত্তেজনাটা বাঁচিয়ে রাখলাম কুলুর জন্য। দ্রুতই পৌঁছে গেলাম কুলু শহরে। কুলু আসলে আধা শহর। সর্বত্র লেগে রয়েছে, পাহাড়ি গ্রাম্যতার চিহ্ন আর ওটাই আমাকে আকর্ষণ করে।

Kullu

এই সেই হোটেল বিয়াসের বারান্দা

কুলুতে সোজা পৌঁছে গেলাম হোটেল বিয়াসের সামনে। এখানে বলে রাখি, পর্যটকদের কাছে কুলু খুব একটা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু নয়। আমার ক্ষেত্রে হল ঠিক উল্টোটা। যাক তাতে যেটা হল পর্যটকশূন্য এক পাহাড়ি গ্রামে একটা গোটা দিন আর পুরো রাত কাটাতে পারব ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল। হোটেল বিয়াসে সহজেই ঘর পাওয়া গেল। বেছে পছন্দের ঘর নেওয়ারও সুযোগ পেলাম। কে না থাকতে চায় এমন ঘরে যার ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই অনন্ত প্রকৃতি ধরা দেয় চোখের ফ্রেমে। সে কথায় পরে আসছি। ছোট্ট যাত্রাপথে কোনও ক্লান্তিই নেই। কুলুতে ঠান্ডা নেই তেমন, তাই গরম পোষাককে মনে হচ্ছে এবারের মতো বিদায় জানানো গেল।

ব্যাগ-পত্তর রেখে ফ্রেশ হতে হতেই চলে এল লাঞ্চ। বারান্দায় রাখতে বললাম। সবাই গিয়ে বসলাম বারান্দায়। বারান্দার নিচেই রয়েছে সবুজ গালিচার লন। সেটা থেকে নামলেই বিয়াস। হোটেল থেকে না বেরিয়েই পৌঁছে যাওয়া যেত নদীর কাছে। কিন্তু হোটেলের তরফে জানানো হল ও পথ আপাতত বন্ধ। দেখতেও পেলাম, ধস নেমে লনের অনেকটাই চলে গিয়েছে নদীতে। রাস্তাটা তাই বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে হোটেল থেকে বেরিয়ে পাশ দিয়েই নদীতে নামার রাস্তা রয়েছে তা আগেই দেখে নিয়েছি। আপাতত নদীর কুলকুল শব্দে বয়ে যাওয়া আর সবুজ পাহাড় দেখতে দেখতে জমে উঠল লাঞ্চ। লাঞ্চ শেষেও অনেকটা সময় বারান্দায়ই কাটল। কেউ কেউ গিয়ে একটু গড়িয়ে নিল। রোদ পড়লেই বাইরে বেরোব ঠিক হল। কারণ আজ শুধু নিজের মতো হেঁটে বেড়ানোর পালা তাই অনেক সময়।

Kullu

কুলুতে গ্রামের পথে

সূর্য পাটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের বাইরে। বিকেলের চা-টা সেদিনের মতো কুলুর পাড়ে বসেই খাব। কুলুর পাড় দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল সব পাথর। জলের মধ্যেও রয়েছে পাথর। জল বাড়লে তা ঢেকে যায়। আবার কমলে সেগুলো মাথা তুলে দাঁড়ায়। তখনও অন্ধকার নামতে বেশ খানিকটা সময় রয়েছে দেখে নদীর পাড়ে না গিয়ে গ্রামের রাস্তায় হাঁটা লাগালাম। যদিও সকলে সে পথে যেতে রাজি হলেন না। তাই আমরা ক’জন। কিছুটা যেতেই শুরু হয়ে গেল মাটির পথ। আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় এখনও বেশ কাঁদা। রাস্তার একদিকে বিভিন্ন জিনিসের চাষ হয়েছে। অন্য দিকে, ছোট ছোট বাড়ি স্থানীয়দের। কচিকাচারা বেরিয়ে পড়েছে খেলতে। বাড়ির ছেলেরা কাজ সেরে ফিরছেন। কেউ কেউ চাষের কাজ করছেন। মহিলারা ঘরের কাজে ব্যস্ত। এ এক গ্রাম্য সংসারের প্রতিচ্ছ্ববি। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পৌঁছে গেলাম। সূর্য তখন অস্তগামী। তাই ফেরার পথ ধরতেই হল। বাকিরা আগে থেকেই বিয়াসের পাড়েই ছিল। আমরাও যোগ দিলাম। এক বিশালাকার পাথরের উপর চড়ে বসলাম। ওটা থেকে নামার সময় বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু ওই পাথরের উপর বসে গরম গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা।

সূর্য অস্ত যেতেই গরম ভাব উধাও। বরং ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। যতক্ষণ সহ্য করা যায় নদীর ধারেই কাটিয়ে দিলাম। আবহাওয়া যাই হোক না কেন পাহাড়ি নদীর জল সব সময়ই কনকনে ঠান্ডা। পাথরের উপর বসে যতক্ষণ সহ্য হয় জলে পা ডুবিয়ে রাখলাম। এমন ভাললাগা সব সময় পাওয়া যায় না। বিয়াসের জলকে লাল রঙে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ আগেই। আকাশের গায়ে তখনও লেগে রয়েছে লাল আভা।  জ্বলে উঠেছে বাতিস্তম্ভের সব আলো। রাস্তার ধারের দোকানগুলো খুলেছে। হঠাৎই একটা জমজমাট পরিবেশ তৈরি হয়েছে কুলু বাজার চত্তর জুড়ে। নদীর ধার ছেড়ে আমরাও উঠে এলাম ওই বাজারে। নানারকমের স্থানীয় জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানগুলো। দেখতে দেখতে রাত নামল কুলুর পাহাড়ে। আমরাও ঢুকে পড়লাম হোটেলে।

Kullu

কুলু ভ্যালি

পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি হয়। তাই ৮টা বাজতেই ডিনার রেডি। এবারও বারান্দাতেই তার আয়োজন হল। এই ট্যুরের শেষ রাত যখন এমন মনোরম পরিবেশে তখন এক মুহূর্তও প্রকৃতিকে চোখ ভরে দেখা আর অনুভব করার সুযোগ ছাড়া যাবে না। রাতের অন্ধকারেও পাহাড়ে একটা অদ্ভুত আলো থাকে যা দিয়ে দেখা যায় রাতের পাহাড়কে। যতক্ষণ বারান্দায় বসেছিলাম বিয়াসকে দেখেছি, বিয়াসের শব্দ শুনেছি। গভীর রাতে শুতে গিয়েছি। না, সে রাতে আর বৃষ্টি আসেনি। জানলা খোলাই ছিল, যাতে ঘুম ভাঙলেই বিয়াসকে দেখতে পাই। সকালের ঘুম ভাঙল হোটেল বয়ের ডাকে। চা নিয়ে হাজির সে। লেপের তলায় বসেই চায়ে চুমুক দিলাম। কেউ কেউ কাপ নিয়ে সোজা পৌঁছে গেল সেই বারান্দায়। আর তো মাত্র কিছুক্ষণ, বিদায় জানাতে হবে কুলুকে, শেষ হবে এবারের মতো হিমাচল ট্যুর। সব ভ্রমণেই প্রকৃতির পাশাপাশি এমন কিছু হোটেলের ঘর, কিছু বারান্দা, কোনও হোটেল বয়, কোনও খাবার মনে থেকে যায় সারাজীবন। এই ট্যুরে যেমন থাকবে আলু জিরা, শিমলার ম্যাল, মানালির কাঁচের হোটেল ঘর আর কুলুর এই বারান্দা। পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে, বিয়াসকে মনে নিয়েই রওনা দিলাম চণ্ডীগড়ের উদ্দেশে।

ছবি—লেখক ও সংগৃহিত

(শেষ পর্ব)

Rohtang Pass-এর আগেই রাস্তা আটকাল সেনা, ষষ্ঠ পর্ব

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle