কুলু আর বিয়াস নিয়ে আমার রোমান্টিসিজম মানালির থেকেও বেশি

কুলু

কুলু কিছুটা হিমাচলের এই অংশের সাইড সিনের মধ্যেই পড়ে। কেউ খুব একটা যে ওখানে থাকে তেমন  নয়। বরং শিমলা, মানালি নিয়েই আপামর বাঙালি বেশি উৎসাহী। কিন্তু হঠাৎ কিসের টানে রুটিনের বাইরে বেরিয়ে কুলুতে রাত কাটালেন, লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


পরিকল্পনাটা কলকাতা থেকেই দানা বেঁধেছিল। কিন্তু তা নিয়ে বাড়ির লোকজনদের কিছু জানানো হয়নি। তাহলেই সবাই রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যাবে। সালটা ১৯৯৯। কলেজ শেষ করে বিভিন্ন পেশাদার কোর্সের পাশাপাশি চাকরীরও ইন্টারভিউ দিচ্ছি আমরা বন্ধুরা। তখনই দিল্লির এক ছোট ম্যাগাজিন থেকে ডাক এল, চাকরীর নয় ইন্টারভিউয়ের। এক তো দিল্লি তার উপর তখনও বাবা-মা ছাড়া বেরনোর অভ্যেস হয়নি। কিন্তু দিল্লি শুনে মনটা যাব যাব করে উঠল। দিল্লি আমার বরাবরই প্রিয়। কিন্তু একা কী করে যাব? আর ঠিক তখনই জুটে গেল আমার দুই বন্ধু। তাঁদের যাওয়ার লক্ষ্য অবশ্যই বেড়ানো। সেই হই হই করে প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া।

কলকাতা থেকে পূর্বা এক্সপ্রেসে দিল্লি। পৌঁছে দু’দিনেই কাজ শেষ হয়ে গেল। ফেরার টিকিট আরও বেশ কিছুদিন পরই করা ছিল ইচ্ছে করেই। নয়া দিল্লি স্টেশন থেকে হাওড়া-কালকা মেলের টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। পুরনো দিল্লি স্টেশন থেকে বেশ রাতের দিকেই ছাড়ে সেই ট্রেন। হ্যাঁ, এখানে বলে রাখা ভাল এত সহজে টিকিট পেয়েছিল কারণ তখন ঘোর বর্ষা। কোনও বুকিং নেই, কীভাবে শিমলা পৌঁছবো তাও জানি না। ভোরের আলো ফোটার আগেই পৌঁছে গেলাম কালকা। স্টেশনটা দেখে রীতিমতো প্রেমে পড়ে গেলাম। সেই ভাললাগা এখনও একইরকম রয়েছে। ছোট্ট ঝকঝকে স্টেশনে দাঁড়িয়ে দূড়ে পাহাড়ের হাতছানি দেখা যায়। অন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে তখন সেই ছোট্ট কালকা-শিমলা শিবালিক এক্সপ্রেস। সেই ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা অন্য কখনও শোনাব। আজ বলব কুলুর কথা।

হিমাচল জুড়ে তখন প্রবল বৃষ্টি। পাহাড়ে বৃষ্টি আমার সব সময়ই পছন্দ। তাই কোনও সমস্যা হয় না। হোটেলের জানলায় বসে পাহাড়ে বৃষ্টি দেখেই আমি কাটিয়ে দিতে পারি পুরো ট্যুর। শিমলা ভ্রমণ নির্বিঘ্নে সেরে যেদিন মানালির পথ ধরলাম। পথেই দেখা কুলুর সঙ্গে। দীর্ঘ রাস্তা, তাই কুলুতে একটু চা পানের বিরতি। তাও আবার বিয়াসের পাড়ে বসে। প্রথম দেখাতেই অসম্ভব একটা ভাল লাগা গ্রাস করেছিল। ড্রাইভার তাড়া না দিলে বিয়াস বা বিপাশা নদীর পাথরের উপরেই সন্ধে হয়ে যেত। দেড়িটা সেখানেই করে ফেলেছিলাম আমরা। যার জন্য পরে প্রবল সমস্যায় পড়তে হয়েছিল মানালির পথে। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম ফেরার পথে কুলুতে এক রাত থাকতেই হবে। মানালির দিন-রাত কেটে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। চারদিকে তখন ধসে আটকে রাস্তা। ফেরার দিন ড্রাইভারকে বললাম, কুলুতে বিয়াসের ধারের হোটেল দেখে দাঁড়াতে। দ্রুতই মানালি থেকে কুলু পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। রাস্তাও পরিষ্কার করেছে ধস সরিয়ে।

প্রথম দেখাতেই হোটেলও পছন্দ হয়ে গেল। রাস্তার উপর হোটেল বিয়াসে নিয়ে গেল আমাদের ড্রাইভার। কিন্তু আমি ঠিক যেটা চাইছিলাম সেটা কী পাব? এখান থেকে কি বিয়াস দেখা যাবে? ভাবতে ভাবতেই ঢুকে পড়লাম। ঘর বেশ ভালই, বিয়াসমুখি। এর থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না। শিমলা, মানালির থেকে ঠান্ডা অনেকটাই কম। ঘর লাগোয়া একটা ছোট্ট বারান্দা। যেখান থেকে সামনে শুধুই বিয়াস। আর তার পাথরে ধাক্কা খেয়ে গর্জন করে ওঠার শব্দ। আর কী চাই। আজ সারাদিন, রাত যে আমার এই বারান্দাতেই কাটবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। চেয়ার টেনে চা নিয়ে বসে পড়লাম। লাঞ্চও বারান্দায় আনিয়ে নিলাম।

অনেকক্ষণ থেকেই বিয়াসের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল। যখন কেউ তাড়া দেবে না। এদিনের থেকে আর মোক্ষম সময় কী হতে পারে। আমাদের হোটেলের লন দিয়েই নেমে যাওয়া যায় একদম বিয়াসের পাড়ে। কিন্তু ধসে সে রাস্তা বন্ধ। তাই খানিকটা ঘুরেই বিয়াসের কাছে পৌঁছতে হল। বিয়াসের গা দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার উপর চা, ম্যাগিসহ নানান খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছে স্থানীয় লোকেরা। সেখানেই কফির অর্ডার দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় বিয়াসকে উপভোগ করতে নেমে পড়লাম নদীর কাছে। নদীর উপর বড় বড় বোল্ডারের একটিকে বেছে নিয়ে উঠে পড়লাম তার মাথায়। এখন আর পারব না নিশ্চিত। সেখানেই কফি এল। নদীর কনকনে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখার দৃশ্যের অনুভূতি লিখে ব্যাখ্যা করা কঠিন। চোখ বুজলে আজও সেই মুহূর্তটাকে দেখতে পাই।

সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম ঝুলা। খানিকটা রোপওয়ের মতো। তবে হাতে টানা। বিয়াস পড়াপাড়ের জন্য লোকাল লোকেরা ব্যবহার করেন। না হলে অনেকটা ঘুর পথে যেতে হয়। অনুরোধ করলে আপনিও সেই অসাধারণ ঝুলায় চেপে বিয়াস পাড় করতে পারেন। এই ঝুলা দেখা গিয়েছিল বীর-জারা সিনেমায়। যখন প্রীতি জিন্টাকে উদ্ধার করে ফিরছিলেন শাহরুখ খান। সেও এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সূর্য ডুবতেই ঝুপুৎ করে অন্ধকার নামল বিয়াসের পাড়ে। আরও সময় কাটানো যেতে সেখানে কিন্তু একদিনে আমাদের তালিকায় রয়েছে স্থানীয় মার্কেটে ঢু মারায় পরিকল্পনা। সেই মতো হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কুলুর স্থানীয় মার্কেটে। এখানে রয়েছে স্থানীয় জিনিস তৈরির ফ্যাক্টরি। জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তবুও কিছু তো কিনতে হবেই। টুকটাক জিনিস কিনে হোটেলে ফিরলাম। মন তো পড়ে সেই বিয়াসের পাড়েই। যত রাত ঘনিয়ে আসছে ততই টের পাচ্ছি অদ্যই শেষ রজনী। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ।

গভীর রাত পর্যন্ত কেটে গিয়েছে বারান্দায়। সকালে ঘুম ভেঙেই লেপের তলা থেকে জানলা দিয়ে বিয়াসের দর্শন পেয়েছি। চায়ের কাপ‌ হাতে আবারও সেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। মনে মনে বলেছিল আরও একবার, না বার বার এসে থাকতে চাই এখানেই। কিন্তু আর হয়ে ওঠেনি এখনও। একবার সত্যিই ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে সেখানে। স্মৃতির সরণি ধরে বিয়াসের জলে পা ডুবিয়ে সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকার। ঝুলায় চেপে মাঝ নদীতে ভেসে থাকার। রাতের অন্ধকারে চাঁদের আলোয় চিক চিক করে ওঠা জলে মেঘের প্রতিবিম্ব দেখার। ফেরার পথে যতক্ষণ পাশে পাশে চলেছে বিয়াস ততক্ষণ চেয়ে থেকেছি। যেন হাত ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে কোনও ভালবাসার মানুষ, আর দেখা হবে না কখনও। সত্যিই ২১ বছর কেটে গিয়েছে আর দেখা হয়নি।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)