হরিদ্বার ভ্রমণ মানেই গঙ্গার ঘাটের সন্ধ্যারতি আর দাদা-বৌদির হোটেলে খাওয়া

হরিদ্বার ভ্রমণহরিদ্বারের সন্ধ্যারতি

হরিদ্বার ভ্রমণ মানেই গঙ্গার ঘাটের সন্ধ্যারতি। দেশ বিদেশ থেকে মানুষ হরিদ্ধার আসে খরস্রোতা কনকনে ঠান্ডা গঙ্গায় ডুব দিতে। তাতে নাকি সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। সঙ্গে সন্ধ্যারতি। সন্ধে নামলেই শয়ে শয়ে প্রদীপ জলে ওঠে। লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


পাহাড় থেকে সদ্য সমতলে হরিদ্বারে নেমেছে গঙ্গা। তাই যেমন স্বচ্ছ্ব জল তেমনই ঠান্ডা। গঙ্গার পাড় ধরে বাঁধা রয়েছে লোহার শিকল। স্নান করতে হলে সেই শিকলের সাহায্য নিতেই হবে। না হলে স্রোত যে কোনও সময় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কখন যে জল বেড়ে স্রোত দ্বিগুণ হবে কেউ জানে না। তাই নিরাপত্তার কথা ভেবে এই শিকলের ব্যবস্থা। তবে স্নান করতে না চাইলে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খরস্রোতা গঙ্গাকে মন ভরে দেখা যায় সারাক্ষণ। সন্ধে নামলে শুরু হয় গঙ্গারতি। গঙ্গাপূজো। হর কি পাউরি ঘাটে তখন নেমে আসে এক টুকরো স্বর্গ।

আমার ঠাকুর ভক্তি নেই বললেই চলে। মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার টানে তাঁদের পরিকাঠামোগত কারণে। তাদের শিল্পকর্মের জন্য। মুসৌরির পাহাড়ে অসাধারণ সময় কাটিয়েই গিয়েছিলাম হরিদ্বার। বাবার ইচ্ছে হরিদ্বার আর বেনারস যাওয়া একবার। বেনারসও পরে গিয়েছি। দেরাদুন থেকে ট্রেনে হরিদ্বার পৌঁছে গেলাম ভোর ভোরই। স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে হলিডে হোম। কলকাতা থেকেই বুকিং করা ছিল। দারুণ ঝাঁচকচকে সাদা মার্বেল বসানো ঘর।

লক্ষ্মণ ঝুলা

স্টেশন থেকে হলিডে হোমের পথেই একাধিক মন্দির চোখে পড়েছে। বেশ  ভিড়। প্রচুর মানুষ এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে। আমরা প্রায় তিনদিন থাকব এই হরিদ্বারে। হাতে অনেক সময়। তাই কোনও তাড়াহুড়ো নেই। হলিডে হোমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে, ব্রেকফাস্ট করে বিশ্রাম। তবে লাঞ্চ যে প্রথম দিন থেকেই দাদা-বৌদির হোটেলে হবে তা পাকা হয়ে গিয়েছিল আগে থেকেই। তখন আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বেশ ফ্যাচাং ছিল। তবে দাদা-বৌদি সে ফ্যাচাংয়ের সুযোগ দেননি।

দুপুর গড়াতেই হাজির হলাম হোটেলের সামনে। একটু তাড়াতাড়িই গেলাম। কারণ এত গল্প শোনা দাদা-বৌদির হোটেলের নামেই খিদে দ্রুত পেয়ে গিয়েছিল। আর তাড়াতাড়ি পৌঁছনোয় ভিড়ও ছিল না তেমন। সঙ্গে সঙ্গে জায়গা পেয়ে গেলাম। পাতায় করে খাওয়া। ধোয়া ওঠা দেরাদুন রাইসের সঙ্গে গাওয়া ঘি আর আলু বা বেগুন ভাজা। আমাকে আর কে পায়। এই মেনু হলে আমি ডবল ভাত খাই আর কিছুই লাগে না। যে তিন দিন ছিলাম ওই খেয়েছি।

এর পর যা যা আসত, যেমন মুগ ডাল, ধোকার ডালনা, আলু-ফুলকপির তরকারি, কিছু খাইনি। শেষ পাতে কখনও চাটনি খেয়েছি। আবার খাওয়া দেখে দ্বিতীয় দিনই দাদা-বৌদি আমার খাওয়ার টাকা নিতে অস্বীকার করেন। যে ক’দিন ছিলাম আমার লাঞ্চের টাকা দিতে হয়নি। শেষদিন দাদা-বৌদি আমাকে এসে বলেছিল, ‘‘তুমি যে কী খাও। তিনদিন ধরে শুধু ঘি-ভাত আর ভাজা খেয়ে থাকলে। এমনটা দেখিনি বাপু।’’

এ তো গেল খাওয়ার কথা। পরবর্তী সময়ে শুনেছি দাদা-বৌদির হোটেলের কোয়ালিটি আর আগের মতো নেই। চারদিকে এমন দাদা-বৌদির হোটেল আরও গজিয়েছে। বিকেল হলেই গোটা হরিদ্বার দাদা-বৌদির হোটেল ছেড়ে হাজির হত গঙ্গার ঘাটে। হালকা অন্ধকারেই শুরু হত আরতি। বিশাল বিশাল প্রদীপ নিয়ে কাসর-ঘণ্টা বাজিয়ে চলত সেই আরতি। যে দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। অন্য এক জগতে নিয়ে যায়।

এর ফাঁকেই রোপওয়ে করে পৌঁছে যাওয়া যায় মনসাদেবী ও চন্ডিদেবীর মন্দিরে। কোমরের জোর পায়ের ভারসাম্য ঠিক থাকলে সিঁড়িও ভাঙা যেতে পারে। তবে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম হরিদ্বারের বিখ্যাত উড়ান খাটোলা সেবার। মানে রোপওয়ের। পাহাড়ের মাথায় মন্দিরের উপর থেকে অনেকটা নিচে হরিদ্বার শহরকে এক ফ্রেমে ধরা যায়।

হর-কি-পাউরি ঘাট

হরিদ্বার গেলে একদিন ঋষিকেশ যাবেন না তা কী আর হয়। ফিরতে হলে সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসা যায়। আমরাও সেই পথই বেছে নিলাম। সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম। হরিদ্বার যতটা ঘিঞ্জি ঋষিকেশ ততটাই ফাঁকা। পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা গঙ্গা। এখানে নিয়মিত র‍্যাফটিং হয়। আর এখানের সব থেকে আকর্ষনীয় বস্তু হল লক্ষ্মণঝুলা। গঙ্গার উপর এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের মাঝে ৪৫০ ফিটের ঝুলন্ত এই ব্রিজ। নদী থেকে ৭০ ফিট উঁচুতে।

১৯২৯ সালে এই ব্রিজ খুলে দেওয়া হয়েছিল সাধারণের জন্য। কথিত আছে, রাম ও লক্ষ্মণ এই পথেই গঙ্গা পাড় করেছিলেন এখন যেখানে এই ব্রিজ রয়েছে। পাশেই রয়েছে রামঝুলাও। মন্দিরপ্রেমীদের জন্য এখানেও রয়েছে প্রচুর বিকল্প। রাতে আলোয় যখন সেজে ওঠে লক্ষ্মণঝুলা তখন অপূর্ব এক স্বর্গীয় রূপ দেখা যায়। এখানেই গঙ্গারতি দেখা যেতে পারে। সেই দৃশ্যও মন ছুঁয়ে যাবে। থাকা যেতে পারে গঙ্গার পারের কোনও রেসর্টে। তবে আমাদের ফিরতে হবে হরিদ্বার। পর দিন কলকাতা ফেরার ট্রেন।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)