Rail Station 6: যে স্টেশন থেকে পৌঁছে যাওয়া যায় লেকের শহরে

সুচরিতা সেন চৌধুরী: এই স্টেশনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল বহু বছর আগে। সালটা ঠিক মনে পড়ছে না। কলেজ শেষ করে তখন মন বেশ উড়ু উড়ু। বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যানটা করেই ফেললাম। তা বলে রাতারাতি অত দূর! এখন ভাবলে নিজেরই বিস্ময় তৈরি হয়। কিন্তু মনের কোণে যখন পাহাড়ের হাতছানি উঁকি ঝুঁকি দিয়ে যায় তখন কিছু ভাবার মানসিকতা থাকে না। সে সময় ইন্টারনেটের যুগ ছিল না। হাতে হাতে ছিল না মোবাইল ফোনও। তাই সম্বল শিয়ালদহ স্টেশন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ভারতবর্ষের ওই অংশে যেতে গেলে সরাসরি কলকাতা শহর থেকেই একটাই ট্রেন রয়েছে। যার নাম ‘বাগ এক্সপ্রেস’ অথবা ‘কাঠগোদাম এক্সপ্রেস’।

আমাদের গন্তব্য ছিল নৈনিতাল। তার পর বার কয়েক এই লেকের শহরে গিয়েছি। কিন্তু প্রথমবারের অভিজ্ঞতা সব সময়ই স্পেশ্যাল। প্রথম প্রেমের মতো। প্রথম যে কোনও অনুভূতি মনের অন্দরে বিশেষ জায়গা দখল করেই থাকে। ‘কাঠগোদাম স্টেশন’ও তাই। এতদিন যে সব পাহাড়মুখী স্টেশনের কথা বলছিলাম সেগুলোর সবটা থেকেই পাহাড়ের হাতছানি পাওয়া যেত। কিন্তু কাঠগোদামের বিশেষত্ব হল, তিনি অবস্থান করছেন পাহাড়ের মাঝখানেই। মানে স্টেশন থেকে বেরলেই রাস্তা পেরিয়ে উঠে গিয়েছে উঁচু পাহাড়। আর ট্রেন যখন স্টেশনে ঢুকবে তখনও পাহাড়ের গা ঘেঁষেই। এই স্টেশনের বিশেষত্ব এটিই।

পাহাড়ি স্টেশনগুলো সব সময়ই বিশালাকার হয় না। ছোট্ট ছিমছাম স্টেশনের গায়ে লেগে থাকে একরাশ আবেগ। মনে আছে হাওড়া থেকে সেবার কাঠগোদাম পৌঁছতে ট্রেনে কাটাতে হয়েছিল পুরো দেড় দিন। স্লিপার ক্লাসের কামরা ধিরে ধিরে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল গন্তব্যে পৌঁছতে পৌঁছতে। দ্বিতীয় দিনের বিকেলে যখন ট্রেনের জানলা দিয়ে পাহাড় উঁকি দিল তখন যেন ক্লান্তির ভাড়ার কিছুটা হলেও কমল। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে আঁকাবাকা পাহাড়ি ট্রেন লাইন পৌঁছে গিয়েছে ছবির মতো সুন্দর সেই স্টেশনে। খুবই মন্থর গতিতে স্টেশনে প্রবেশ করে ট্রেন। স্টেশনের ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু মানুষ ফেরার ট্রেন ধরার অপেক্ষায়।

এই স্টেশনেই যেন শেষ হয়ে গিয়েছে পৃথিবীটা। যেখানে দেখা যায় রেল লাইনের শেষ অংশ।  প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে পাহাড়ের পাদদেশে থমকে গিয়েছে ট্রেন লাইন। তার আর পর নেই। সেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে মনে হবে সময়টা থমকে গিয়েছে এখানেই। লাইন ধরে হেঁটে পাহাড়টা ছুঁয়ে আসা যায় সহজেই। কিছুটা পাথুরে আবার কিছুটা সবুজ। বর্ষার বৃষ্টি যেন সবুজের বাহার বাড়িয়েছে স্টেশন চত্তর ঘিরে। সেই সময় মনে পড়ছে চির চেনা স্টেশনগুলোর মতো সেখানে কোনও দোকানপাট ছিল না। তবে স্টেশন চত্তর থেকে বাইরে পা রাখলেই দেখা পাওয়া যাবে সেই গাড়ির হাঁক ডাক। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেশনের ভাললাগাকে সঙ্গে করে সেদিন রওনা দিয়েছিলাম লেকের শহরের দিকে।

সেবার ফেরাটা এই পথে হয়নি। কিন্তু তারও বেশ কিছু বছর পর যখন আবার নৈনিতালে পৌঁছলাম পরিবারের সঙ্গে তখন পরিকল্পনা না থাকলেও তালেগোলে, ট্রেন বিভ্রাটে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই প্রথম দেখা পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রেল স্টেশনে। বিশেষ কিছু বদল হয়নি তখনও সেই স্টেশনের। এক দুটো দোকানপাট গজিয়েছে স্টেশন চত্তরে ঠিকই কিন্তু সেই পৃথিবীর শেষ প্রান্তটা একই রয়েছে। এখানেই থমকে গিয়েছে বিশাল ভারতীয় রেলের একটা অংশ। যে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে কাঠগোদাম স্টেশন, সেই স্টেশন মনে হল একটু বুড়ো হয়েছে। অক্টোবরের আবহাওয়ায় কিছুটা রুক্ষ। কিন্তু স্টেশন চত্তর একই আবেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামনের পাহাড়টা যেন স্টেশনটাকেই পাহারা দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে।

সেই কবে তৈরি হয়েছিল এই লাইন। কাঠগোদামের ঠিক আগের স্টেশনটি হল হলদোয়ানী। সেটিও পাহাড়ের মধ্যেই। কিন্তু অনেক পড়ে তৈরি হয় কাঠগোদাম। আগে হলদোয়ানী পর্যন্তই ট্রেন চলত। হলদোয়ানী পর্যন্ত লাইন তৈরি হয়েছিল ১৮৮৪-তে। ১৯০১-এ সেই লাইন পৌঁছয় কাঠগোদামে। সেই সময় ছোট্ট একটা গ্রাম ছিল কাঠগোদাম। মাত্র ৩৭৫ জন‌ বাস করত সেখানে। স্টেশন হওয়ার পর বড় হয় সেই গ্রাম। কিন্তু ভাললাগাটা থেকে গিয়েছে একই। পাহাড়মুখী সব স্টেশনের যেমন হয়। বেড়েছে ট্রেনের সংখ্যাও। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে ট্রেন পৌঁছয় এখানে। বাংলা থেকে সময় লাগলেও দিল্লি বা লখনউ থেকে তেমন সময় লাগে না। শেষবার যখন নৈনিতাল গেলাম তখন দিল্লি থেকে শতাব্দি এক্সপ্রেসে হলদোয়ানী নেমেছিলাম। মনে হচ্ছিল ছুঁয়ে আসি কাঠগোদামকে। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আবার কখনও সুযোগ এলে দেখা হবে প্রিয় স্টেশনের সঙ্গে।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle