নতুন বছরে রবি ঠাকুরের আপন দেশে

ভেবেছিলাম ছুটিটা জমে যাবে। আসলে ছুটিও ছিল না। ছুটি নিতে হয়েছিল। বছরের শেষ দিন কি আর অফিসের চার দেওয়ালে মন টেকে!

ছুটি পেতেই তাই বেরিয়ে পড়া রবি ঠাকুরের দেশে। কলকাতা থেকে মাত্র ৪ ঘণ্টা। প্রচুর ট্রেন। যদিও ছুটির সময় টিকিট মেলা বেজায় মুশকিল। হঠাৎ বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন টিকিট কাটতে বসলাম, তখন ভাবিইনি এত সহজে টিকিট পাব। পেয়ে গেলাম। ভাগ্য এতটাই ভাল! হাওড়া-মালদহ টাউন সুপারফাস্টের এসি চেয়ারকারে শনিবারের এক দুপুরে হৈ-হৈ করে শুরু হয়ে গেল যাত্রা।

অতি চেনা শান্তিনিকেতন। পরিচিত লাল মাটির রাস্তার প্রতিটি মোড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে মাটির ভাড়ে রাবড়ি-দই গোগ্রাসে শেষ করে ফেলাটাও খুব জানা। সঙ্গে চেনা ধুলো মেখে ফেরা। এ বারের শুরুটাও হয়ে গিয়েছিল সেই সব ভাবনা নিয়েই। বোলপুর স্টেশনে যখন নামলাম, তখন সন্ধে নেমে এসেছে শান্তিনিকেতনের আকাশে। সঙ্গে জাঁকিয়ে ঠান্ডা। বছর শেষের রাত বলে কথা! ঠান্ডা পড়বে না, তা কি হয়? হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। স্টেশন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। কারণ, ফেরার দিন ভোর সাড়ে ছ’টায় ট্রেন। দূরে থাকলে রাতের ঘুমের ১২টা বেজে যেত। যদিও তা ১২ পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে ছিল!

 

যাই হোক, হোটেল পৌঁছে ব্যাগপত্তর ঘরে ফেলেই বেরিয়ে পড়া। টোটো করে সোজা পৌষ মেলার মাঠ। সেখানে তখন ভাঙা হাট। সামনের দিকের কয়েকটি দোকানে টিম টিম করে জ্বলছে আলো। সেখানেও উপচে পড়ছে মানুষের ঢল। আমরা সে দিকে না গিয়ে সোজা চলে গেলাম বাজারের ভিতরের সেই চায়ের দোকানে। যেখানকার চা আমাদের বড় প্রিয়। সঙ্গে ওদের চিকেন-চাউমিন। সেই কোন সকালে খেয়ে বেরিয়েছি। সবার পেটে তখন ছুঁচোর ডন। খেয়ে বাজার ঘুরে আবার হোটেলে ফেরা। রাতের খাবার খেয়ে দ্রুত ঘুমের দেশে পৌঁছে যাওয়া।

পর দিন সকাল থেকে যে শুধুই রবি ঠাকুরের দেশে ঘুরে বেড়ানো! সকাল হতে একটু দেরিই হল। ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য সেই বাজার। সেখান থেকে ভাঙা মেলার মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখনও কালী মন্দির তো কখনও ধূধূ প্রান্তর, আবার কখনও আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে প্রায় প্রান্তিকের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি খেয়ালই করিনি। পা, কোমরের যন্ত্রণা জানান দিল অনেকটা হেঁটে ফেলেছি। টোটোওয়ালাকে বললাম, ‘‘বোলপুর স্টেশনে যাব।’’ তিনি বললেন, ‘‘এখান থেকে প্রান্তিক একদম কাছে। চলুন নামিয়ে দিচ্ছি।’’ তাই সই। টোটো করতেই তো বেরনো।

প্রান্তিক স্টেশনে কিছু ক্ষণ কাটিয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম। হোটেলে ফিরে স্নান সেরে আবার বেরিয়ে পড়া। সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই চেনা স্থাপত্য, চেনা গাছ, চেনা রাস্তায় নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। হয়তো পেলাম, হয়ত বা না। কিন্তু মনের আনন্দে অনেকটা সময় কেটে গেল সেখানেই। সঙ্গে রাবড়ি আর দই তো ছিলই। সেখান থেকে বেরিয়ে এ বার ছিল সোনাঝুরি, খোয়াইয়ের পালা। সুরটা বদলাতে শুরু করল একটু পর থেকেই। দূর থেকে ভেসে আসা বাউলের সুরে কখনও মন উড়ে গেল প্রান্তিক ঠিকানায়। ফিরিয়ে আনল সাঁওতালি নাচের তাল। সেখানেই নানা জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে স্থানীয় মানুষ। বাঙালি মন শুধুই কি বেড়ায়? কিছু না কিনে ফিরলে তো বেড়ানোটাই বৃথা। তাই কেনাও হল জমিয়ে। সেখানেই আকাশের রং বদলে সূর্যাস্ত ধরা দিল মনের ক্যামেরায়। বছর শেষের গোধূলির আলো গায়ে মেখে থাকল অনেকটা সময়। তখন ভেসে আসছে বাউলের সুর, ‘মিলন হবে কত দিনে...’।

অন্ধকার ঘনিয়ে এল খোয়াইয়ের পথে। তত ক্ষণে কাপড়ের পসরা গোটাতে শুরু করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। তাঁদের সঙ্গেই আড্ডা জুড়ে দিলেন আমার সঙ্গী। তাঁরা আপ্লুত হয়ে আমাদের চা-ও খাওয়ালেন। তার পর ফেরার পালা। সঙ্গে বেশ খানিকটা মন খারাপ। রবি ঠাকুরের দেশের দিন যে শেষ হয়ে এল। তাই ৩১ ডিসেম্বরের রাতটা চুটিয়ে মজা করার। খুঁজে পেলাম খড়িমাটি রিসর্ট। জমিয়ে খানা-পিনা শেষে মনের আনন্দে নতুন বছরকে বরণ করলাম রবি ঠাকুরের আপন দেশে।

২০১৮-র প্রথম সকাল সেখানেই। ঠিক গত বছরের মতোই। পরের প্রতিটি নতুন বছরকে এই লাল মাটির দেশ থেকেই বরণ করে নেওয়ার মনে মনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেরার ট্রেন ধরলাম। বছরের প্রথম সূর্য ধরা দিল ট্রেনের জানলায়।