পলাশ ফুটলে, ফুটে ওঠে বড়ন্তীর মন

পলাশ ফুটলে মনটাও কেমন উড়ু উড়ু হয়ে যায়। ঘরে, অফিসে কোথাও মন টেকে না। প্রতি দিনের চেনা সেই সিসিডি বা শপিংপল, রেস্তোরাঁ, গঙ্গা পাড়ের সুন্দর পরিবেশ... সব পেরিয়ে মন ছুটে যেতে চায় পলাশের কাছে।

যে পলাশ প্রকৃতিকে রাঙিয়ে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে কোনও কোনও অঞ্চলে। আমিও সেই বাঙালির দলে। মন ঘরে টেকে না। মন খালি পাড়ি দেয় তেপান্তরে।

আবারও পলাশ ফুটতে শুরু করেছে। আবারও রং ধরতে শুরু করেছে বড়ন্তীর সেই পলাশের জঙ্গলে। যে জঙ্গলে নাম জানা পাখির ডাক শুনতে শুনতে কেটে গিয়েছিল মনের সব গ্লানি। যে বড়ন্তীতে ফুলের রঙে রেঙে উঠেছিল ধূসর হয়ে যাওয়া মন। সেই বড়ন্তীতে শুনলাম আবার ফুলের দল ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করেছে।

গত মার্চে এই পলাশ লালের আগুন দেখতেই এক দিনের জন্য ছুটে গিয়েছিলাম বড়ন্তীতে। কাকভোরে হাওড়া থেকে ট্রেন পৌঁছে দিয়েছিল আসানসোলে। সেখান থেকে আমার অ্যাম্বাসাডর স্টেশন চত্বর পেরিয়ে গ্রামের পথ ধরতেই চোখের সামনে খুলে গিয়েছিল বিস্তৃত প্রান্তর। আরে, এতো জঙ্গল! যে জঙ্গলের রং শুধুই লাল। লালের আনাচ-কানাচ দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে সবুজ পাতারা। তবে এই সময় সবুজ অনেকটাই পিছিয়ে। গাছের দখল নিয়েছে লাল পলাশ।

 

পলাশের জঙ্গল পেরিয়ে যখন গন্তব্যে গিয়ে থামল আমার চার-চাকা, তখন মনের সর্বত্র ঘর করে নিয়েছে শুধু লাল পলাশ। পলাশবাড়ির গেট পেরিয়ে ডান দিকের ছোট্ট ঘরটাই রাখা ছিল আমার জন্য। ভোররাতে উঠে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। তাই বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ভাল মতো স্নান সেরে ডাইনিং হলে যেতেই প্লেট সাজিয়ে চলে এল লাঞ্চ। এক্কেবারে ঘরের খাবার। মুগডাল, বেগুনভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, রুই মাছের ঝোল, চাটনি দিয়ে লাঞ্চ সাঙ্গ করে একপ্রস্ত ঘুম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন সুয্যিমামা মধ্য গগন থেকে কিছুটা পশ্চিমের দিকে হেলে পড়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তড়িঘড়ি ঘরের বাইরে এসে সেই সূর্যের আলোয় নিজেকে কিছুটা ভিজিয়ে নিলাম। বড়ন্তীর সে দিনের বিকেলটা বেশ দীর্ঘই ছিল। পলাশবাড়ির পিছনে বিরাট পলাশের জঙ্গল যে এত ক্ষণ চোখেই পড়েনি। সেই জঙ্গলে গাছ যেন ভরে রয়েছে ফুলে তেমনই গাছের তলাও। সেই ফুলের সঙ্গে কথা বলা যায় মন খুলে। ফুল নিয়ে খেলা যায়। মাথায় লাগিয়ে মিশে যাওয়া যায় সাঁওতালদের গানের তালে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামল মুরারডি লেকের ধারে। লেকের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন রিসর্টে ফিরলাম, তখন অন্ধকার নেমেছে বড়ন্তীর গ্রামে।

মুড়ি মাখা, পেঁয়াজি আর চায়ের সঙ্গে সান্ধকালীন ভোজ শেষ হতে না হতেই রেসর্টের লনে শুরু হয়ে গেল সাঁওতালদের নাচ-গানের আসর। রেসর্টের অনেকেই পা মেলালেন তাতে। এক অন্য জগতে বিচরণ শেষে রাতের খাওয়ার ডাক এল। সেই লাঞ্চের মতোই জমিয়ে ডিনার।

ডিনার শেষে রেসর্টের লনেই হেঁটে বেড়ানো, আড্ডা। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে কুকুরের দল। রাতে ঘুমের মাঝেই টিনের ছাদে টুপটাপ ফুল পড়ার শব্দ কানে এল সারা রাত। ভোর হল ফেরার বার্তা নিয়ে। সেই পলাশের জঙ্গল পেরিয়েই শহুরে পথে ফেরা। ফুলের লাল মনের রঙে মিশে গেল সারা জীবনের জন্য।

আবার আসব ফিরে, প্রতিশ্রুতি তো থাকলই।