সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল, ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান আবেগ

Durand Cup 2022

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল — কালজয়ী এই গান গেয়েছিলেন কিংবদন্তি মান্না দে। এর চেয়ে বড় সত্যি যে আর কিছু নেই, তার প্রমাণ অতীতে বারবার পাওয়া গিয়েছে। ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে। আর বাঙালির ফুটবল-প্রেম চরমে ওঠে, যখন মাঠে মুখোমুখি হয় বাংলার দুই ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল, যা ‘বড় ম্যাচ’ বলে পরিচিত বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। এ প্রজন্মের ফুটবলপাগলদের কাছে আবার এই ফুটবল-যুদ্ধ ‘ডার্বি’ নামে জনপ্রিয়। আরও স্পষ্ট করে বললে ‘কলকাতা ডার্বি’।

কথায় বলে ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’। বাংলার মানুষ যে সারা বছর ধরে তেরো রকমের উৎসবে মেতে থাকে, তা বোঝাতেই এই প্রবাদ। তবে প্রবাদটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, এই ডার্বি-ও বাঙালির আর এক উৎসব। তাই সেই প্রবাদে তেরো পার্বণ না বলে চোদ্দ পার্বণ বললে খুব একটা ভুল হয় না বোধহয়। সারা বছরে যতবার কলকাতা ডার্বির যুদ্ধ লাগে, ততবার সারা বাংলা জুড়ে উৎসবের মেজাজ দেখা যায়। বাঙালি তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল সবুজ-মেরুন বাহিনী, অর্থাৎ মোহনবাগানের সমর্থক। অন্য দল, লাল-হলুদ ব্রিগেড, অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক।

যারা মোহনবাগান সমর্থক, তাদের আবার ‘ঘটি’-ও বলা হয়। যারা এ পার বাংলার আদি ও অকৃত্রিম পরিবারের সদস্য, তাদের ‘ঘটি’ বলা হয়ে থাকে। আর যাঁরা ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গ বা ওপার বাংলা অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশ থেকে এ পার বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ও সেই সময় থেকে এ দেশেরই স্থায়ী নাগরিক হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ‘বাঙাল’ বলা হয়। এ কোনও সরকার স্বীকৃত ভাগাভাগি নয়, শুধুই কথিত ভাবে চলে আসছে এই বিভাজন।

এই দুই শ্রেণির মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করে এই দুই ক্লাব। ‘ঘটি’-দের ক্লাব মোহনবাগান ও ‘বাঙাল’-দের ক্লাব। তাই এই দুই ক্লাবের ফুটবল-যুদ্ধ মানে ঘটি-বাঙালেরও লড়াই। তাই এই দুই ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ আদতে দুই শ্রেণির বাঙালির মান-সম্মান, আবেগ ও আত্মাভিমানের দ্বৈরথ। বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপুজোয় যেমন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। তেমনই ডার্বি থেকেও এ বাংলার কোনও মানুষকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে দেখা যায় না।

এই বঙ্গে কোনও শিশু জন্ম নিলে সে প্রথম দিন থেকেই তার পারিবারিক সূত্রেই হয় ‘ঘটি’, নয় ‘বাঙাল’-এর তকমা পেয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকও সে হয়ে যায় জন্মের দিন থেকেই। তার ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। এমন বহু পরিবার রয়েছে, যেখানে একই ছাদের তলায় দুই ক্লাবেরই সমর্থক থাকেন। ‘ঘটি’ পরিবারে জন্ম নিয়েও লাল-হলুদ সমর্থক বা ‘বাঙাল’ হয়েও সে সবুজ-মেরুনের দলে, এমনও দেখা যায়। এই অবস্থায় কলকাতা ডার্বি এলেই বহু পরিবারে গৃহযুদ্ধ অবধারিত।

দুই ক্লাবই শতাব্দীপ্রাচীন হলেও বয়সের দিক থেকে ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে এগিয়ে মোহনবাগান ক্লাব। ১৮৮৯ সালে জন্ম মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের। উত্তর কলকাতার মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূপেন্দ্রনাথ বসু ১৮৮৯-এ এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ক্লাবের অবদান রয়েছে বলে স্বীকার করেন ইতিহাসবিদরা। ১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের ফুটবলাররা খালি পায়ে খেলে বুট পরে খেলা ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেন।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের এই জয়কেই স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, ওই জয়ের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও তার পর থেকেই ভারতবাসীর মনে হতে শুরু করে, নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ফুটবল মাঠে ইংরেজদের হারানো সম্ভব হলে স্বাধীনতা আন্দোলেনেও সফল হওয়া সম্ভব।

ইস্টবেঙ্গলের জন্ম ১৯২০-তে। কথিত আছে যে, ইস্টবেঙ্গলের জন্মের পিছনেও মোহনবাগানের পরোক্ষ অবদান রয়েছে। কোচবিহার কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল মোহনবাগান ক্লাব ও কলকাতার আর এক প্রাচীন প্রতিষ্ঠান জোড়াবাগান ক্লাব। সেই ফাইনালে জিতেছিল মোহনবাগান। শোনা যায়, ওই ম্যাচে ‘পূর্ববঙ্গীয়’ হিসেবে পরিচিত শৈলেশ বসুকে মাঠে নামতে না দেওয়ায় জোড়াবাগান ক্লাবের সহ সভাপতি সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, যিনি নিজেও ‘পূর্ববঙ্গীয়’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করেন এবং সেই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে এক নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন, যার নাম দেন ইস্টবেঙ্গল। নতুন এই ক্লাবের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সুরেশচন্দ্র ছাড়াও ছিলেন রাজা মন্মথনাথ চৌধুরী, রমেশচন্দ্র (নশা) সেন ও অরবিন্দ ঘোষ। বঙ্গভঙ্গের আগে ও পরে এই ক্লাবের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে।

১৯২১-এর ৮ অগাস্ট কোচবিহার কাপে প্রথম মুখোমুখি হয় এই দুই ক্লাব। তার পর থেকে গত ৯৯ বছরে মোট কতবার দুই ক্লাব ফুটবল মাঠে মুখোমুখি হয়েছে, তার সরকারি বা সঠিকতম পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। বহু গবেষণার পরে বেশির ভাগ গবেষকই একটা ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, কলকাতা ডার্বির সংখ্যা ৩৭০-এরও বেশি। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা এই কলকাতা ডার্বিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব দ্বৈরথ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এল ক্লাসিকো (বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ), নর্থ-ওয়েস্ট ডার্বি (ম্যাঞ্চেস্টার বনাম লিভারপুল), ওল্ড ফার্ম ডার্বি (রেঞ্জার্স বনাম সেলটিক) ও সুপারক্লাসিকোর (রিভারপ্লেট বনাম বোকা জুনিয়র্স) মতো ফুটবলের বিশ্বখ্যাত চিরপ্রতিদ্বন্দিতার সঙ্গে একই আসনে বসিয়েছে।

ফুটবল মাঠে কলকাতার দুই প্রধানের রেষারেষি কখনও থামার নয়। বরং আরও বাড়তে থাকবে। হয়তো একশো বছর পরেও ফুটবলের এই চিরপ্রতিদ্বন্দিতা অমর হয়ে থাকবে। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন বা এএফসি ভারতের এক নম্বর ফুটবল লিগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যাকে, সেই হিরো আইএসএলে এই দুই ক্লাব অংশ নেওয়ার পরে এই বিশ্বখ্যাত ডার্বির আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বায়ন ঘটেছে।

কলকাতা ডার্বির এই শততম বর্ষে দেশের সেরা ও আধুনিকতম ফুটবল লিগ হিরো আইএসএলে পা রেখে দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবই বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতীয় ফুটবলের বিশ্বায়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার মহাযজ্ঞে সামিল তারাও। যে লিগের প্রতি ম্যাচের টাটকা অ্যাকশন সারা বিশ্বের ৮২টি দেশ ও অঞ্চলের ফুটবলপ্রেমীরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন টিভি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, সেই লিগে বাংলার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাবের মুখোমুখি হওয়া মানে সারা বিশ্বে ফুটবল-উৎসব। বাংলার মানুষ থাকেন না, এমন দেশ খুব কমই আছে আর প্রতিটি বাঙালির হৃদয়েই হয় লাল-হলুদ, নয় সবুজ-মেরুন জার্সির বসবাস চিরকাল। তাই শুধু ভারত নয়, শুক্রবার সারা বিশ্ব মাতবে ফুটবলের এই মহাযুদ্ধ নিয়ে।

যেমন মেতেছিল গত ২৭ নভেম্বর প্রথম লেগের ম্যাচে। ২-০ গোলে জিতে শেষ হাসি হাসে সবুজ-মেরুন শিবির। ৪৯ মিনিটে রয় কৃষ্ণা ও ৮৫ মিনিটে মনবীর সিংয়ের দুর্দান্ত দুই গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দীদের হারায় তারা। বিপক্ষের কড়া ডিফেন্সের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে গোল করার সে রকম সুযোগ তৈরি করতে পারেনি দেশের সেরা লিগে প্রথম খেলতে নামা লাল-হলুদ বাহিনী। ৫৮ শতাংশ বল পজেশন থাকলেও ম্যাচের দখল নিতে পারেনি তারা।

শুক্রবার ফের মুখোমুখি হতে চলেছে ভারতের দুই জনপ্রিয়তম ফুটবল দল। ফের বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। বাঙালির ফুটবল-আবেগের পারদ উঠবে চরমে। ‘ঘটি’-দের প্রিয় চিঙড়ি ও ‘বাঙাল’-দের পছন্দের ইলিশ মাছের চাহিদা উঠবে চরমে। পাড়ায় পাড়ায় দুই ক্লাবের বিশাল বিশাল পতাকা উড়বে। প্রিয় তারকাদের ছবি টাঙিয়ে তাতে মালা দিয়ে পুজোও করা হবে। আর শুক্রবার সন্ধেবেলা সবাই দল বেঁধে বসে পড়বে হয় টিভির সামনে, নয় মোবাইলের সামনে ম্যাগনিফাইং স্ক্রিন লাগিয়ে। বিভিন্ন ক্লাবের মাঠে টাঙানো হবে জায়ান্ট স্ক্রিন।

কাল যে বাংলার চতুর্দশ পার্বণ— ডার্বি উৎসব। বাঙালির আবেগ, আনন্দ-হতাশা, আশা-নিরাশা নির্ভর জড়িয়ে থাকে যার সঙ্গে। গত ডার্বিতে সবুজ-মেরুন বাহিনী জিতেছে। এ বার লাল-হলুদ ব্রিগেড তার বদলা নিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। এ তো একশো বছর ধরে হয়ে আসছে।

(লেখা ও ছবি আইএসএল ওয়েব সাইট থেকে)

(আরও খবর জানতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)