Kiyan Nasiri-র হ্যাটট্রিকে ডার্বি জয় বাগানের

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় Kiyan Nasiri– এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে যাই বলুন না কেন, তাও যেন উপযুক্ত মনে হবে না। শনিবার ফতোরদার পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ২১ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড কিয়ান নাসিরি জীবনের প্রথম ডার্বি খেলতে নেমে যে ভাবে বিপক্ষের ডিফেন্সের বুক চিরে আধ ঘণ্টার মধ্যে পরপর তিনটি গোল করে এটিকে মোহনবাগানকে জেতালেন, তার জন্য বোধহয় কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয়।

সারা ম্যাচে দুরন্ত লড়াই করে ড্যারেন সিডোলের গোলে এগিয়ে যাওয়া এসসি ইস্টবেঙ্গল এক ২১ বছরের তরুণের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হল এ দিন। হিরো আইএসএলের চতুর্থ কলকাতা ডার্বিতে ডেভিড উইলিয়ামস পেনাল্টি মিস করা সত্ত্বেও সাফল্যের ধারা অব্যহত রেখে ৩-১-এ চতুর্থ ডার্বি জিতে নিল সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। এই জয়ের ফলে লিগ টেবলে আট থেকে চার নম্বরে উঠে এল এটিকে মোহনবাগান। শীর্ষে থাকা হায়দরাবাদের সঙ্গে তাদের এখন মাত্র চার পয়েন্টের ফারাক।

শনিবার ৬১ মিনিটের মাথায় দীপক টাঙরির জায়গায় কিয়ানকে মাঠে নামান এটিকে মোহনবাগান কোচ হুয়ান ফেরান্দো। চলতি হিরো আইএসএলে মাত্র একটি ম্যাচে কয়েক মিনিটের জন্য নামা কিয়ান কী করতে পারেন, সেই সম্পর্কে কোনও হোমওয়ার্কই বিপক্ষ শিবিরের ছিল না। এই ভেবেই হয়তো এই সিদ্ধান্ত নেন ফেরান্দো। কারণ, অচেনা শত্রু বরাবরই বিপজ্জনক।

সেই অচেনা শত্রুই শেষ পর্যন্ত এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবিরের জন্য চরম দুঃসংবাদ বয়ে আনেন। মাঠে নেমে প্রথমেই যে টাচটি করেন তিনি, তাতেই আসে প্রথম গোল। ম্যাচের শেষ মিনিটে ও স্টপেজ টাইমের তৃতীয় মিনিটে আরও দু’টি গোলে নিজেকে চিনিয়ে দেন কিয়ান নাসিরি। ভারতীয় ফুটবলে জন্ম হল এক নতুন তারকা স্ট্রাইকারের।

আশির দশকের কিংবদন্তি ফুটবলার জামশেদ নাসিরির পুত্র কিয়ান বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর রক্তেই ফুটবল। কিন্তু তাঁর বিখ্যাত বাবা যা কখনও পারেননি, শনিবার মাঠে নেমে সেই বিরল ডার্বি-হ্যাটট্রিক করে কেরিয়ারের শুরু করে দিলেন কিয়ান নাসিরি।

এ দিন রয় কৃষ্ণাকে ছাড়াই এটিকে মোহনবাগানের প্রথম একাদশ নামান তাদের কোচ হুয়ান ফেরান্দো। প্রবীর দাসকে প্রথম এগারোয় রাখেন তিনি। সামনে ডেভিড উইলিয়ামস ও তাঁর পিছনে লিস্টন কোলাসো, হুগো বুমৌস ও মনবীর সিংকে রেখে ৪-২-৩-১-এ দল সাজান সবুজ-মেরুনের স্প্যানিশ কোচ। রয় কৃষ্ণা ছিলেন ডাগ আউটে। তাঁর সঙ্গে সেখানে বসে থাকতে দেখা যায় সন্দেশ ঝিঙ্গনকেও।

অন্য দিকে, আন্তোনিও পেরোসেভিচ ও মার্সেলো রিবেইরোকে সামনে রেখে ৪-৪-২-এ দল সাজান লাল-হলুদ শিবিরের স্প্যানিশ কোচ মারিও রিভেরা। এ দিন হীরা মন্ডল প্রথম এগারোয় ফেরেন। তবে মহম্মদ রফিককে এ দিন প্রথম এগারোয় দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন ডাগ আউটে।

শুরু থেকেই  দুই উইংকে কাজে লাগিয়ে আক্রমণের চেষ্টা শুরু করে এটিকে মোহনবাগান। এসসি ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণ স্বাভাবিক ভাবেই ছিল পেরোসেভিচ ও মার্সেলোকেন্দ্রিক। তবে শুরুর ২৫ মিনিটে সবুজ-মেরুন বাহিনীকেই বেশি আক্রমণে উঠতে দেখা যায়। এসসি ইস্টবেঙ্গল অবশ্য নিজেদের গুটিয়ে রাখেনি। নিজেদের রক্ষণকে আঁটোসাঁটো রেখে আক্রমণে ওঠে মাঝে মাঝে।

শুরুতেই রাইট ব্যাক অঙ্কিত মুখার্জি চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওায়ায় এসসি ইস্টবেঙ্গলের পরিকল্পনা কিছুটা হলেও ধাক্কা খায়। তাঁর বদলে অমরজিৎ সিং কিয়ামকে নামিয়ে সেই ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করেন রিভেরা। ২৫ মিনিটের মাথায় প্রায় ফাঁকা গোল পেয়ে যান মার্সেলো। ডান দিক থেকে উড়ে আসা বল রিসিভ করার সময় তিরি তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এই সুযোগে বক্সের মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে পড়েন মার্সেলো। সামনে অনেকটা এগিয়ে আসা অমরিন্দর ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। এটিকে মোহনবাগানের গোলকিপারের পাশ দিয়ে তিনি শটও মারেন গোলের দিকে। কিন্তু বল গোলের বাঁ দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়।

এর পাঁচ মিনিট পরেই বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণে ওঠা লিস্টন কোলাসোর গোলমুখী কোণাকুনি শট বাঁ দিকে ডাইভ দিয়ে বাঁচান এসসি ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার অরিন্দম। ৩৮ মিনিটের মাথায় বুমৌসের কর্নারে হেড করে গোলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন প্রীতম কোটাল। বল গোলের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

দুই দলের রক্ষণের সঙ্গে আক্রমণের লড়াই এ দিন রীতিমতো চরমে ওঠে। এসসি ইস্টবেঙ্গল গত ম্যাচে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে চার গোল খেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এ দিন তাদের সঙ্ঘবদ্ধ রক্ষণ দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। ২৫ মিনিটের মাথায় তিরির ওই একটি ভুল ছাড়া ওপেন প্লে-তে আর কোনও গলদ এ দিন চোখে পড়েনি সবুজ-মেরুন রক্ষণে। বারবারই দুই দলের অ্যাটাকারদের গোলের মরিয়া চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের বারবার দুর্দান্ত দক্ষতায় প্রতিহত করেন দুই দলেরই ডিফেন্ডাররা।

এ দিন মার্সেলো ও পেরোসেভিচের যুগলবন্দী দেখে লাল-হলুদ সমর্থকেরা আশাবাদী হয়ে উঠতেই পারেন। যে ভাবে এসসি ইস্টবেঙ্গলের দুই স্ট্রাইকার বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের চাপে রাখেন, তাতে বলা যেতে পারে দলের আক্রমণের দুর্বলতা হয়তো কাটতে চলেছে।

বিরতিতে বল পজেশনে এটিকে মোহনবাগান অনেকটাই এগিয়ে ছিল (৬৪-৩৬)। গোলমুখী শটের পরিসংখ্যানেও তারা এগিয়ে থাকলেও (২-১) আসল কাজটা করতে পারেনি কোনও পক্ষই। এটিকে মোহনবাগান মূলত বাঁ দিক দিয়ে (কোলাসো) আক্রমণে উঠলেও ডানদিকে (মনবীর) ততটা তৎপরতা দেখাতে পারেনি। এসসি ইস্টবেঙ্গল মূলত ডানদিকের উইং ও মাঝ বরাবর আক্রমণে ওঠে পেরোসেভিচ ও মার্সেলোর মাধ্যমে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই এটিকে মোহনবাগানের জোড়া আক্রমণে নড়ে যায় এসসি ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণের ফোকাস। প্রথমে বাঁ দিক দিয়ে ওঠা কোলাসো বক্সের মাথা থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে যে গোলমুখী শট নেন, তা ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। এর পরেই বক্সের সামনে থেকে প্রবীর দাসের হাওয়ায় ভাসানো ক্রসে শুভাশিস গোলের সামনে হেড করলেও তা গোলের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

৫৪ মিনিটের মাথায় ডান দিকের উইং দিয়ে বল নিয়ে বক্সে ঢুকে যে কোণাকুনি শট নেন পেরোসেভিচ, তা অমরিন্দর বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে না বাঁচালে তখনই এগিয়ে যেত এসসি ইস্টবেঙ্গল। তবে এগিয়ে যেতে তাদের আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র দু’মিনিট পরেই কর্নার থেকে ড্যারেন সিডোল গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। পেরোসেভিচের কর্নার গোলের সামনে ‘ল্যান্ড’ করার সময় বলের সামনেই ছিলেন ডাচ মিডফিল্ডার। পায়ের ভিতরের অংশ দিয়ে গোলে বল ঠেলে দেন তিনি। তাঁকে আটকাতে এসেও ব্যর্থ হন দীপক টাঙরি।

৬১ মিনিটের মাথায় বিপক্ষকে সারপ্রাইজ দিতে যে পরিবর্তনটি করেন ফেরান্দো, সেই পরিবর্তনে সত্যিই চমকে যায় লাল-হলুদ রক্ষণ। দীপক টাঙরির জায়গায় নামা কিয়ান নাসিরি তাঁর প্রথম টাচেই গোল পেয়ে যান এ দিন। কিংবদন্তি ফুটবলার জামশেদ নাসিরির পুত্র অনেক দিন পর মাঠে নামায় তিনি এ দিন শুরুর দিকে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের অলক্ষ্যেই ছিলেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ছ’গজের বক্সের সামনে থেকে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে নেওয়া শটে গোল করে সমতা এনে ফেলেন কিয়ান। এর ঠিক আগেই প্রবীর ডান দিক দিয়ে কোলাসোর উদ্দেশ্যে ক্রস দেন ও কোলাসো সেই বল বক্সের মধ্যে পাঠালে আদিল খান তা ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন। এই ভুলের সুযোগই কাজে লাগিয়ে নেন তরুণ কিয়ান।

কিন্তু ১-১ হওয়ার তিন মিনিট পরেই ডেভিড উইলিয়ামস যেটা করেন, তাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢোকা কোলাসোকে অবৈধ ভাবে বাধা দেন অমরজিৎ। রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। পেনাল্টি নিতে যান উইলিয়ামস। কিন্তু তাঁর শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়! ডার্বিতে গোল করে দলকে এগিয়ে দেওয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেন অস্ট্রেলীয় তারকা, এ সত্যিই অভাবনীয়।

এর পরেই মার্সেলো ও সিডোলকে তুলে নিয়ে ও হামতে ও রফিককে নামান রিভেরা। কিয়ানের মতো সুপার সাব হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন লালরিনলিয়ানা হামতেও। ৮০ মিনিটের মাথায় নাওরেম মহেশ বক্সের ডান দিক থেকে পাস দিয়ে হামতেকে প্রায় গোল সাজিয়ে দিয়েছিলেন। হামতে গোলে শটও নেন। কিন্তু সামনে থাকা অমরিন্দর দুরন্ত দক্ষতায় তা বাঁচিয়ে দেন।

ডেভিড উইলিয়ামসের পেনাল্টি মিস যদি অবিশ্বাস্য হয়, তা হলে ম্যাচের শেষ কয়েক মিনিটে কিয়ান নাসিরি যা করেন, তা আরও অবিশ্বাস্য। নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে ও স্টপেজ টাইমের তৃতীয় মিনিটে আরও দু’টি গোল করে দলকে মহার্ঘ্য ডার্বি-জয় এনে দেন তিনি।

৯০ মিনিটের মাথায় ডেভিড উইলিয়ামসের হেড পোস্টে লেগে ফিরে আসার পরে সৌরভ দাসের ভুল ক্লিয়ারেন্সের সুযোগ নিয়ে বক্সের মাঝখান থেকে জোরালো শটে গোল করেন সম্পূর্ণ অরক্ষিত জামশেদ-পুত্র। তার তিন মিনিট পরেই ডান দিক দিয়ে বল নিয়ে বক্সে ঢোকা মনবীর সিং গোল করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর পিছনে থাকা কিয়ান তেমনই আর এক জোরালো ও নিখুঁত শটে হ্যাটট্রিকের গোল করেন। সেই সময়েও তিনি ছিলেন পুরোপুরি ‘আনমার্কড’। কিয়ানের এই হ্যাটট্রিকেই এসসি ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি-জয়ের আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। তবে হারলেও এ দিন এসসি ইস্টবেঙ্গল সারা ম্যাচে যে লড়াকু পারফরম্যান্স দেখায়, তাতে লাল-হলুদ সমর্থকদের গর্বিত হওয়াই উচিত।

এটিকে মোহনবাগান দল: অমরিন্দর সিং (গোল), তিরি, শুভাশিস বোস, প্রীতম কোটাল (অধি), প্রবীর দাস, কার্ল ম্যাকহিউ, দীপক টাঙরি (কিয়ান নাসিরি), হুগো বুমৌস, মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসো, ডেভিড উইলিয়ামস (লেনি রড্রিগেজ)।

এসসি ইস্টবেঙ্গল দল: অরিন্দম ভট্টাচার্য (গোল), আদিল খান (অধি), অঙ্কিত মুখার্জি, ফ্রানিও পর্চে, হীরা মন্ডল, ড্যারেন সিডোল (মহম্মদ রফিক), ওয়াহেংবাম লুয়াং, সৌরভ দাস, আন্তোনিও পেরোসেভিচ (শুভ ঘোষ), মার্সেলো রিবেইরো (লালরিনলিয়ানা হামতে), নাওরেম মহেশ (সেম্বয় হাওকিপ)।

(লেখা আইএসএল ওয়েব সাইট থেকে)

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)