ISL 8 SC East Bengal: প্রথম লেগ শেষে লাল-হলুদের খতিয়ান

ISL 8 SCEB vs NEUFC

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: বিদেশি ফুটবলার ও কোচেদের নিয়ে এসে ভারতীয় ফুটবলের দ্রুত উন্নতি— ছোট করে হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের অন্যতম উদ্দেশ্য যখন এটাই, তখন বলতে হবে, সেই উদ্দেশ্যে অনেকটাই সফল ভারতের এক নম্বর ফুটবল লিগ। এবং সেটা সবাইকে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এসসি ইস্টবেঙ্গল (ISL 8 SC East Bengal)। মঙ্গলবার বাম্বোলিমের অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে যখন এগারো জন ভারতীয়কে নিয়ে দল নামান এসসি ইস্টবেঙ্গলের অন্তর্বর্তী কোচ রেনেডি সিং, তখন ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীদের নিশ্চয়ই গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল। এটা ঠিকই যে রেনেডির সামনে এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তিনি তা স্বীকারও করে নেন। কিন্তু তাঁর হাতে যে একেবারেই কোনও বিদেশি ফুটবলার ছিলেন না, তা কিন্তু নয়। মাঝমাঠে ডাচ ফুটবলার ড্যারেন সিডোল ও স্লোভেনিয়ান আমির দার্ভিসেভিচকে নামাতে পারতেন তিনি। কিন্তু তাঁদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিচার করে যে রেনেডি তাঁর হাতে থাকা ভারতীয় ফুটবলারদেরই অগ্রাধিকার দেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন, এটাই বড় কথা।

যেটা সত্যি, সেটা সোজাসুজি মেনে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যে কোনও অসুবিধা নেই, সেটাই বুঝিয়ে দেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক ও লাল-হলুদ শিবিরের এই প্রাক্তন তারকা। লড়াইটাও কম করেনি তারা। অসাধারণ ডিফেন্সিভ ওরিয়েন্টেশন বা রক্ষণ সংগঠনের মাধ্যমে গ্লাসগো রেঞ্জার্সের প্রাক্তন অ্যাটাকার গ্রেগ স্টিউয়ার্ট ও ফর্মে থাকা জর্ডান মারের মতো ফুটবলারদের যে ভাবে সারাক্ষণ আটকে রাখেন তাঁরা, তা রীতিমতো প্রশংসা করার মতোই। দেশের ফুটবল মহলে লাল-হলুদ শিবিরের এই লড়াই যথেষ্ট প্রশংসিতও হয়েছে।

লড়াই, তবু অসফল

মনে রাখবেন মঙ্গলবার ম্যাচ জিতে যে দল লিগ টেবলের শীর্ষে উঠে পড়ে সেই জামশেদপুর এফসি-কে কিন্তু জয়সূচক গোলের জন্য ৮৮ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ফরোয়ার্ড বলওয়ান্ত সিংয়ের মাইক্রো সেকেন্ডের ভুলে গোলটা করে দেন সুযোগসন্ধানী ইশান পন্ডিতা, যিনি এ রকম গোল আগেও অনেকবার করেছেন। বলওয়ান্ত বিশেষজ্ঞ ডিফেন্ডার নন, বর্তমানে পুরোপুরি ফিটও নন। ওই জায়গায় কোনও বিশেষজ্ঞ ডিফেন্ডার থাকলে হয়তো এই ভুল করতেন না। তাই তাঁকে পুরোপুরি দোষ দেওয়াটা হয়তো ঠিকও হবে না। কিন্তু এক নম্বরে ওঠার যোগ্য একটা দলের বিরুদ্ধে যে লড়াইটা করে এসসি ইস্টবেঙ্গল, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।

শুধুমাত্র ভাল আক্রমণ বিভাগের অভাবে তাদের জয় এখনও অধরা রয়ে গিয়েছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে ক্রোয়েশিয়ান স্ট্রাইকার আন্তোনিও পেরোসেভিচ পাঁচ ম্যাচের জন্য নির্বাসিত হওয়ায় দলের অনেকটাই ক্ষতি হল। এই সময়ে যদি পেরোসেভিচ থাকতেন, তা হলে হয়তো জমজমাট রক্ষণের পাশাপাশি তিনি, সেম্বয় হাওকিপ, লালরিনলিয়ানা হামতে-র ত্রয়ী বিপক্ষের রক্ষণকেও পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারতেন। সেটা না হওয়ায় এসসি ইস্টবেঙ্গলকে রক্ষণাত্মকই লাগল।

পরের ম্যাচ থেকে হয়তো রেনেডি সিং আর কোচ হিসেবে দলের পূর্ণ ক্ষমতায় থাকবেন না। মারিও রিভেরা সেই জায়গা নেবেন। তবে তিনি যদি রেনেডির দর্শন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে রক্ষণের এই শক্তি বজায় রেখে মাঝমাঠ ও আক্রমণকে শক্তিশালী করার দিকে মন দেন, তা হলে হয়তো দলের উন্নতি হবে। গতবার যেমন জানুয়ারির দলবদলে ব্রাইট এনোবাখারের মতো একজন স্ট্রাইকার দলের আক্রমণ বিভাগকে তরতাজা করে তুলেছিলেন, এ বার সেরকমই কোনও স্ট্রাইকার এলে এবং তাঁর সঙ্গে পেরোসেভিচের ভাল বোঝাপড়া গড়ে উঠলে এসসি ইস্টবেঙ্গল হয়তো ম্যাচ জিততে শুরু করবে।

ব্যর্থতার ময়না তদন্ত

গতবার রবি ফাউলার প্রস্তুতির তেমন সময় পাননি। কিন্তু এ বার হোসে মানুয়েল দিয়াজের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা হয়নি। তা সত্ত্বেও ফাউলারের দল কিন্তু গতবার অষ্টম ম্যাচেই প্রথম জয় পেয়েছিল। টানা সাতটি ম্যাচে তারা অপরাজিতও ছিল। কিন্তু এ বারের মতো টানা এগারো ম্যাচে জয়হীন থাকার জ্বালা সহ্য করতে হয়নি তাদের। গত মরশুমের শেষ চার ম্যাচের ফল দেখলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৫। লাল-হলুদের ইতিহাসে বোধহয় এ রকম টানা ব্যর্থতার অধ্যায় কখনও লেখা হয়নি, যা এ বার হল।

ক্লাবের আভ্যন্তরীন সমস্যা মিটিয়ে অগস্ট মাস থেকে দলবদলে নেমে পড়ে এসসি ইস্টবেঙ্গল। অক্টোবরের ৭ তারিখ থেকে প্রস্তুতি শুরু করেন লাল-হলুদ শিবিরের কোচ-ফুটবলাররা। হিরো আইএসএলে তাদের প্রথম ম্যাচ ছিল ২১ নভেম্বর। অর্থাৎ প্রায় দোড় মাস সময় নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করে তারা। সম্পুর্ণ নতুন কম্বিনেশন তৈরির করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্প্যানিশ কোচ দিয়াজ। এই সময়টাও যে তাদের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট ছিল না, তা লিগ শুরু হওয়ার পরে উপলব্ধি করতে পারেন তিনি।

গত মরশুমে গোল্ডেন গ্লাভ জেতা গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যকে সই করায় তারা। ভারতীয় দলে খেলা ডিফেন্ডার আদিল খান ও অভিজ্ঞ রাজু গায়কোয়াড় ও তরুণ হীরা মন্ডলকেও নেওয়া হয় ব্যাকলাইনে। তাঁদের ভরসা জোগাতে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ব্যাক পারথ্ গ্লোরির প্রাক্তন তারকা টমিস্লাভ মর্চেলা। এ ছাড়াও দলের রক্ষণ সামলানোর জন্য ক্রোয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা হয় তাদের অনূর্ধ্ব ২১ জাতীয় দলের স্টপার ফ্রানিও পর্চেকে, যিনি আবার ইতালির ‘সিরি আ’ ক্লাব লাজিওর প্রাক্তন খেলোয়াড়।

মাঝমাঠে ভারতের অনূর্ধ্ব ২৩ দলের খেলোয়াড় অমরজিৎ সিং কিয়ামের সঙ্গে অভিজ্ঞ মহম্মদ রফিক, জ্যাকিচন্দ সিং, সৌরভ দাস ও বিকাশ জায়রুকে যেমন রাখা হয়, তেমনই আয়াক্স অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা ডাচ মিডফিল্ডার ড্যারেন সিডোল ও স্লোভেনিয়ান মিডফিল্ডার আমির দার্ভিসেভিচকেও নিয়ে আসা হয় মাঝমাঠের শক্তি বাড়াতে।

গতবার যেমন নাইজেরিয়া থেকে আসা ফরোয়ার্ড ব্রাইট এনোবাখারে হয়ে উঠেছিলেন দলের অন্যতম প্রধান ভরসা, সে রকমই এ বার তাঁরই স্বদেশীয় ড্যানিয়েল চিমা চুকুউকে আক্রমণভাগের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে নিয়ে আসা হয়। আশির দশকে ভারতীয় ফুটবলে ঝড় তোলা চিমা ওকোরির নামেন প্রতি সুবিচার করতে পারবেন ‘ছোট চিমা’, সে রকমই আশা করা হয়েছিল। আক্রমণে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা হয় ক্রোয়েশিয়ার ফরোয়ার্ড আন্তোনিও পেরোসেভিচকে। এই দু’জনে মিলে দলের গোল-মিটার চালু রাখবেন বলেই আশা করেছিলেন সমর্থকেরা। কিন্তু যতটা আশা করেছিলেন তাঁরা, তা পাননি।

অতীতের যে পারফরম্যান্স দেখে এই বিদেশিদের বাছাই করা হয়েছিল, ভারতে আসার পরে বেশির ভাগই তার সুনাম বজায় রাখতে পারেননি। বিশেষ করে দুই ডিফেন্ডার মর্সেলা ও পর্চে এবং ফরোয়ার্ড চিমা। তাঁরা যে ভারতের মাঠ ও আবহাওয়ার সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারবেন না বা ফুটবল জীবনে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তা তাঁদের আগমনের আগে বোঝার উপায় ছিল না বোধহয়। একমাত্র পেরোসেভিচই এ বারের বিদেশিদের মধ্যে ভাল নিয়োগ।

আশার আলোর রেখা

অরিন্দম, রাজু, বিকাশ, জ্যাকিদের মতো ভারতীয়রাও নিজেদের সেরাটা দিতে পারেননি প্রথম লেগে। যার ফলে কোনও সময়ই তারা দল হিসেবে ভাল খেলে উঠতে পারেনি। রেনেডি দায়িত্ব নেওয়ার পরে কিছুটা হলেও সেই দিকে এগিয়েছে লাল-হলুদ বাহিনী। দল হিসেবে রক্ষণ সামলানো, দল হিসেবে প্রতি আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করা, মাঝমাঠেও একসঙ্গে থাকা— এ সবই তারা করেছে রেনেডির সময়ে। রক্ষণে সফল হলেও মাঝমাঠ ও আক্রমণে তেমন ফর্মে থাকা খেলোয়াড় না থাকায় সফল হতে পারেনি তারা।

স্প্যানিশ কোচ দিয়াজ যে ম্যাচের পরে দায়িত্ব ছেড়ে দেন, সেই হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচেও যথেষ্ট লড়াকু পারফরম্যান্স দেখায় এসসি ইস্টবেঙ্গল। সেই ম্যাচ থেকেই লড়াইয়ে ফেরা শুরু দলটার। এই লড়াইকে তারা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, যদি রক্ষণ ও আক্রমণের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য চলে আসে। তবে সে জন্য আরও সময় দিতে হবে তাদের। একেবারে শেষ স্থান থেকে প্রথম চারে ঢোকাটা অসম্ভব নয়, কিন্তু বেশ কঠিন কাজ। সেই অঘটনের আশা না করাই বোধহয় ভাল। কিন্তু যে লড়াকু মনোভাবের জন্য বিখ্যাত লাল-হলুদ বাহিনী, তা দ্বিতীয় লেগে দেখা গেলে, একাধিক অঘটনের কারণ হয়ে উঠতে পারে তারা।

প্রথম লেগের খতিয়ান

জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে ১-১ ড্র দিয়ে এ বারের লিগ শুরু করে এসসি ইস্টবেঙ্গল। কলকাতা ডার্বিতে এসসি ইস্টবেঙ্গল আক্রমণাত্মক মেজাজে শুরু করলেও এটিকে মোহনবাগান জেতে ৩-০-য়। ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে সবার আগে লাল হলুদের ডাচ খেলোয়াড় ড্যারেন সিডোলই গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরেও হাফ ডজন গোল খায় তারা। শেষ পর্যন্ত ৬-৪-এ ম্যাচ জেতে ওডিশা। চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে এসসি ইস্টবেঙ্গল লড়াই করলেও গোলশূন্য ড্র করে লিগের দ্বিতীয় পয়েন্ট অর্জন করে। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে সারা ম্যাচে সাত-সাতটি গোল হলেও কোনও পয়েন্ট অর্জন করতে পারেনি এসসি ইস্টবেঙ্গল। ৪-৩-এ জেতে এফসি গোয়া। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করলেও ১-১ ড্র করে স্প্যানিশ কোচ হোসে মানুয়েল দিয়াজের দল।

নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-ও ২-০-য় হারায় তাদের। এই নিয়ে চতুর্থবার হার মানে তারা। বছরের শেষে ম্যাচে অবশ্য হায়দরাবাদ এফসি-কেও জিততে দেয়নি তারা। আগের ছয় ম্যাচে যে ঝকঝকে পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছিল নিজামের শহরের দলের, তা যেন কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে যায় সে দিন। যার জেরে কোনও দলই জয়ের হাসি নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি। ফল হয় ১-১। বছর পাল্টালেও অবশ্য তাদের ভাগ্য বদলায়নি। তবে মানসিকতা বদলেছে। বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে লাল-হলুদ ব্রিগেড। যারা এ বার সবচেয়ে বেশি গোল করেছে এবং দুর্ধর্ষ আক্রমণ বিভাগ যাদের, সেই মুম্বই সিটি এফসি-কে একটি গোলও করতে দেয়নি তারা। প্রথম লেগের পরেও লাল-হলুদ বাহিনী লিগ টেবলের সর্বশেষ স্থানে থাকলেও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে আশার আলোর যে রেখা তারা দেখেছে, সে দিকে এগিয়ে আলোর দুনিয়ায় প্রবেশ করাই দ্বিতীয় লেগে তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

(লেখা ও তথ্য আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)