আইএসএল ফাইনালে দুই মস্তিষ্কের লড়াইয়ে ফেরান্দো বনাম সাইমন

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: ফুটবল খেলাটা মাঠে হয় ঠিকই, কোচেরাও কথায় কথায় বলেন, তাঁরা তো আর মাঠে নেমে খেলবেন না, খেলবে তাঁর দলের ফুটবলাররা। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে মাঠের বাইরেও একটা যুদ্ধ হয়। সেটা কোচিং স্টাফদের যুদ্ধ। কোচেরা কেমন, কী রকম তাদের কৌশল এবং পরিকল্পনা, কেমন তাদের খেলার স্টাইল, কতটা আগ্রাসী বা রক্ষণাত্মক তাদের মানসিকতা— এ সবের ওপর অবশ্যই নির্ভর করে দলের সাফল্য, ব্যর্থতা।

শনিবার হিরো আইএসএল ফাইনালেও মাঠে যেমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, তেমনই মাঠের বাইরের লড়াইটাও রীতিমতো জমজমাট হয়ে উঠবে। একদিকে যখন এটিকে মোহনবাগানের ‘তরুণ’ স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো ঘুটি সাজাচ্ছেন। অন্য দিকে, তখন প্রতিপক্ষকে বধ করার নীল নকশা তৈরি করছেন সুনীল ছেত্রীদের ইংরেজ কোচ সাইমন গ্রেসন।

শনিবার সন্ধ্যায় ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে কার কৌশল ও পরিকল্পনার সোনালী ফসল ফলাবে, তা তো একমাত্র সময়ই বলতে পারবে। কিন্তু দু’জনেই যে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে পরষ্পরের রণনীতিকে ব্যর্থ করতে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। ফাইনালে কোন কোচ কী রকম কৌশল নিয়ে নামতে পারেন, কার কৌশলের সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বা কম, এই নিয়েই আলোকপাত করা হচ্ছে এই প্রতিবেদনে।

বাধা-বিপত্তি পেরিয়েও মরিয়া চেষ্টার অভ্যাস

হিরো আইএসএলে তিনটি মরশুম কাটিয়ে দিলেন হুয়ান ফেরান্দো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনওবার ট্রফি হাতে তুলতে পারেননি। এ বারই প্রথম সেই সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে। গতবার এটিকে মোহনবাগানকে সেমিফাইনালে তোলার পর যখন সেখান থেকে ছিটকে যায় তারা, তখন থেকেই সমর্থকদের মধ্যে প্রত্যাশা দানা বাঁধতে থাকে, এ বার হয়নি তো কী হয়েছে, পরের বার অবশ্যই হবে।

সমর্থকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করলেও তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করাটা অনেক বেশি কঠিন। তাই ফেরান্দোকে এমন কিছু করে দেখাতে হবে, যা তিনি আগে কখনও করেননি। যদিও তিনি কৌশলে ও পরিকল্পনায় বেশি পরিবর্তনের পক্ষপাতী নন। বরাবরই তিনি বলে থাকেন, “লিগের খেলা হোক বা প্লে-অফ, আমাদের পরিকল্পনায় বা মানসিকতায় কোনও পরিবর্তন হবে না”। কিন্তু ফাইনালে বোধহয় সেই জায়গায় আটকে থাকলে চলবে না। ফাইনালে জিততে গেলে বিশেষ কিছু তো করতেই হবে।

৩২ বছর বয়স থেকে কোচিং করে আসা ফেরান্দোকে এখন অভিজ্ঞ কোচই বলা যায়। স্পেন, মলদোভা, গ্রিসের ক্লাব ফুটবলে কোচিং করে আসায় ইউরোপের বিভিন্ন ঘরানার ফুটবল প্রায় গুলে খেয়েছেন বলা যায়। ২০২০-২১ মরশুমে এফসি গোয়ার কোচ হিসেবে ভারতীয় ফুটবলে প্রবেশ করার পরে প্রতিবারই নিজের দলকে একটা ভদ্রস্থ জায়গায় নিয়ে গিয়ে মরশুম শেষ করেছেন। প্রথমবার এফসি গোয়াকে সেমিফাইনালে তোলেন এবং ২০২১-এর ডুরান্ড কাপে তাদের চ্যাম্পিয়ন করেন। দ্বিতীয় মরশুমে এটিকে মোহনবাগানকেও সেমিফাইনালে তোলেন। এ বার তাদের ফাইনালে তুলেছেন।

তাঁর প্রশিক্ষণে থাকা এফসি গোয়া হিরো আইএসএলে টানা ১৫টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল, যা আজ পর্যন্ত তাদের ক্লাবের নজির হয়ে রয়ে গিয়েছে। পরের মরশুমের মাঝখানে এটিকে মোহনবাগানের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তাদের টানা ১৩টি ম্যাচে অপরাজিত রেখেছিলেন ফেরান্দো, যা সেই সময়ের পরিস্থিতি অনুযায়ী ছিল প্রায় অভাবনীয়। দলকে লিগশিল্ডের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েও দাঁড় করিয়ে দেন তিনি। জামশেদপুর এফসি-কে হারাতে পারলেই সেই খেতাব পেয়ে যেত তারা। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

কেমন হতে পারে ফেরান্দোর কৌশল?

“অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, সেমিফাইনালে ওরা কিছুটা হলেও রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে। আগ্রাসী মনোভাব দূরে সরিয়ে রেখে প্রতিপক্ষকে একটু বেশিই সমীহ করে খেলে ওরা। তার কারণ, সেমিফাইনালে ওদের সামনে চ্যালেঞ্জটা বেশ কঠিন ছিল। তাই বেশি ঝুঁকি নেয়নি”, বলছেন ইংল্যান্ডের ক্লাব ফুটবলে খেলা প্রাক্তন খেলোয়াড় ও হিরো আইএসএলের ধারাভাষ্যকার পল মেসফিল্ড। তাঁর মতে, “ফেরান্দোর হাতে এখন ভাল ডিফেন্সিভ ব্লক রয়েছে। তাই রক্ষণের দিক থেকে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তিনি। ঘর বাঁচানো নিয়ে তিনি খুব একটায় চিন্তা রয়েছেন বলে মনে হয় না। বরং ফাইনালে আক্রমণে বেশি মন দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা যাবে”।

স্প্যানিশ কোচের শক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মেসফিল্ড জানান, “সারা মরশুমে অনেক চোট-আঘাত সমস্যায় পড়তে হয়েছে ফেরান্দোকে। এখন দলের অবস্থা স্থিতিশীল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সমস্যাগুলো যে ভাবে সামলেছেন, তা ছিল অনবদ্য। এখন তারই ফল পাচ্ছেন। জনি কাউকোর মতো কার্যকরী ফুটবলার যখন দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর জায়গায় কার্ল ম্যাকহিউকে নিয়ে আসার মতো সঠিক একটা সিদ্ধান্ত নেন ফেরান্দো। ম্যাকহিউ রক্ষণের সামনের ভাগে থাকায় দলের রক্ষণ বেশ মজবুত হয়ে গিয়েছে। এই দুর্দান্ত ব্যাকলাইনই তাঁর দলের শক্তি অনেকটা বৃদ্ধি করেছে। তা ছাড়া গোলে বিশাল কয়েথের মতো পাথরের মতো শক্ত একটা দেওয়াল থাকলে তো কোনও কথাই নেই।”

ইংলিশ ফুটবলের অদম্য মনোভাব যাঁর রক্তে

ফেরান্দোর চেয়ে এগারো বছরের বড় সাইমন গ্রেসন ইংলিশ ক্লাব ফুটবল থেকে যে অভিজ্ঞতার ঝুলি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন, তা যে কতটা মূল্যবান, তা হিরো আইএসএলে প্রবেশ করেই বুঝিয়েই দিয়েছেন তিনি। গত বছরের শেষে তাঁর দল লিগ টেবলের দশ নম্বরে ছিল। সেই জায়গা থেকে টেনে তুলে বেঙ্গালুরু এফসি-কে আজ ফাইনালে তুলেছেন তিনি। এই কৃতিত্বের কথা লিগের ইতিহাসে অবশ্যই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

কোচ হিসেবে ভারতে এসে প্রথম টুর্নামেন্টেই (ডুরান্ড কাপ) দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। সেটাই ছিল ভাল কিছু করে দেখানোর বার্তা। ব্ল্যাকপুল, লিডস ইউনাইটেড, সান্ডারল্যান্ড, হাডার্সফিল্ড টাউন, ব্র্যাডফোর্ড সিটি ক্লাবের কোচ হিসেবে কাজ করে আসা গ্রেসন একাধিকবার লিগ ওয়ানের সেরা কোচের পুরস্কার কেন পেয়েছেন, তা ভারতে এসেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। ২০২২-এ বেঙ্গালুরু এফসি-তে যোগ দেওয়ার আগে ইংল্যান্ডের ক্লাব ফুটবলে প্রায় সাতশো ম্যাচে কোচের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ইংলিশ ফুটবলের সেই অদম্য মনোভাব, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল না ছাড়ার ইচ্ছেটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন সুনীল ছেত্রীর সতীর্থদের মধ্যেও।

কেমন হতে পারে গ্রেসনের কৌশল?

“রক্ষণ নির্ভর ফুটবল খেলাতে পারেন তিনি। কারণ, তাঁর দলে সে রকম সাতজন ফুটবলার এবং গোলকিপার আছেন। বাকি তিনজনকে সুযোগ বুঝে প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় হানা দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন”, বলছেন বেঙ্গালুরুর প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় মিডফিল্ডার এরিক পার্তালু। তাঁর মতে, “শুধুমাত্র এই কৌশলের ওপর নির্ভর করে সারা ম্যাচ কাটানো অবশ্য কঠিন। সেক্ষেত্রে তাকে কৌশল বদলাতেই হবে। তবে তাঁর দলের রক্ষণ যে যথেষ্ট শক্তিশালী, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নিজের দলের শক্তিকে নিশ্চয়ই কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। সুনীল ছেত্রীর জায়গায় শিবশক্তিকে যে ভাবে ব্যবহার করেছেন, তারও প্রশংসা অবশ্যই করা উচিত। ”।

মেসফিল্ড মনে করেন, “গ্রেসন সেমিফাইনালে ফ্ল্যাট ব্যাক ফোর-এ রক্ষণ সাজান খেলায় কিছুটা বদল আনার জন্য। এই সিস্টেম বদলানোর ক্ষমতাটা গ্রেসনের অদ্ভূত। ফইনালে নতুন কোনও কৌশল দেখলে অবাক হব না। ম্যান ম্যানেজমেন্টের দিক থেকেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী। দলের দুঃসময়ে তিনি যে ভাবে তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও দলের সবাইকে এককাট্টা রেখেছেন এবং খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন, তার প্রশংসা করতেই হবে। শিবশক্তির গতিটাকে কাজে লাগিয়েছেন গ্রেসন। আর সুনীল ছেত্রীকে ঠিক কখন মাঠে আনলে, কতটা খেলালে ফল পাওয়া যাবে, সেই বুদ্ধিটাও অসাধারণ”।

শনিবার হিরো আইএসএল ফাইনালে দুই ইউরোপীয় ঘরানার কোচের যে লড়াই দেখা যাবে, তা যে উপভোগ্য হয়ে উঠবে এমনটা আশা করা যেতেই পারে। কিন্তু কোন ঘরানা বাজিমাত করবে, তা পুরো নির্ভর করছে ফুটবলারদের ওপর। এখানেই সব কোচের হাত-পা বাঁধা থাকে। তাঁরা নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিলেও যে সেরা ফলটা পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা কোনওদিনই ছিল না, আজও নেই।

(লেখা ও ছবি আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle