সোনার বলের নেপথ্যে এক অন্য লড়াইয়ের গল্প

সোনার বলের নেপথ্যেলুকা মডরিচ।

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: সোনার বলের নেপথ্যে রয়েছে এক অন্য লড়াইয়ের কাহিনী। লুকা মডরিচের বেড়ে ওঠার লড়াইয়ের গল্প। যা শুনলে শিউড়ে উঠতে হয়।

চোখের সামনে জ্বলছিল থাকার বাড়িটা। ছোট্ট ছেলেটার তখন পুরো বুঝে ওঠারও বয়স নয়। তার মধ্যেই দেখল প্রিয় ঠাকুরদাকে কারা যেন গুলি করে মেরে ফেলল তার চোখের সামনে। বুঝতে বুঝতেই সব শেষ। কষ্ট পাওয়ারও সময় ছিল না। সার্বিয়া মিলিটান্টের ক্ষোভের শিকার হয়েছিল পুরো মডরিচ পরিবার।  সেটা ১৯৯১ সাল। বালকানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েএছে। উত্তর ডালমাটিয়ায় ভেলেবিট পাহাড়ের কাছে ছোট্ট গ্রামের মডরিচ পরিবারের উপর আছড়ে পড়েছিল উগ্রপন্থীদের প্রাণঘাতী আক্রমণ।

আজ সেই ছোট্টখাট্ট রোগাসোগা ছেলেটা বিশ্ব ফুটবলে চমক দেখিয়েছেন। তিনি লুকা মডরিচ। ক্রোয়েশিয়া ফুটবল দলের অধিনায়ক। এই রোগা চেহারা নিয়েও যে অসাধারণ ফুটবল খেলা যায় তা দেখিয়েছেন এই উদ্বাস্তু ছেলেটি। গৃহহারা, গৃহকর্তাহারা পরিবারটিকে দেশ ছাড়া হতে হয়েছিল সেই সময়। না হলে আজকের লুকা মডরিচকে পেত না ক্রোয়েশিয়া। বাবা-মায়ের সঙ্গে মডরিচি ছেড়ে লুকার পরিবার চলে যায় জাদারে। সেখানে এক হোটেলে রাখা হয়েছিল উদ্বাস্তুদের। সেখানেই একটিই ঘরে জায়গা হয় লুকার পরিবারের।

এই সেই বাড়ি যা পুড়ে গিয়েছিল ছোট্ট লুকার চোখের সামনে।

সেখানে ছিল না কোনও আলোর ব্যবস্থা, ছিল না জল। সারাদিন শুধু গ্রেনেড আর গুলির শব্দ শুনে ঘুমের মধ্যেই আঁতকে উঠত বাচ্চা ছেলেটি। রাস্তায় চলাও ছিল ভয়ের। কোথায় ল্যান্ড মাইন পুঁতে রাখা আছে কেউ জানত না। তার মধ্যেই ওই হোটেলের কার পার্কে ফুটবল নিয়ে চলত লুকার ছুটোছুটি। যুদ্ধ যখন থামল জানা গেল মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের। যুগস্লাভিয়ায় সিভিল ওয়্যার শুরু হয়েছিল ১৯৯১এ শেষ হয় ২০০১এ। ১০ বছর চলে যুদ্ধ। তার মধ্যেই বড় হয়ে ওঠা লুকা মডরিচের।

যদিও মডরিচ বেশি কথা বলতে চান না তাঁর সেই সময় নিয়ে। বিশ্বকাপে মধ্যে দলকে ফাইনালে তুলে অবশ্য মডরিচ বলেছিলেন, ‘‘যুদ্ধের মধ্যে বেড়ে ওঠা তাঁকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই আমমরা উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন ৬। কঠিন সময় ছিল।মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায়। কিন্তু এমন স্মৃতি কেউ মনে করতে চাইবে না।’’

বিশ্বকাপের সব খবর একক ক্লিকে

ডিনামো জাগরেবে ফুটবল শুরু মডরিচের। লুকা মডরিচের পারিবারিক বাড়িটি বিদ্ধস্ত অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার পাশে। তার আশপাশে যাওয়া আজও নিষিদ্ধ। যুদ্ধে কোথায় কোথায় ল্যান্ড মাইন রাখা হয়েছিল জানা নেই। পাহাড়ের কোলের সেই ছোট্ট গ্রাম এখন পরিত্যক্ত। অনেক যন্ত্রনার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়য়ে আধপোড়া বাড়ি গুলো। মডরিচ জানিয়েছেন, ‘‘অনেক বছর আমরা একটা হোটেলে ছিলাম। টাকা ছিল না। কিন্তু তখনও আমি ফুটবল নিয়ে থাকতাম। আমার প্রথম শিন গার্ডে ব্রাজিলিয়ান রোনাল্ডোর ছবি ছিল। আর ওটা আমার খুব প্রিয় ছিল।’’

এই সেই লুকা মডরিচ যিনি ডেনমার্কের বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস করেও পরের ম্যাচে শুট আউটে দলকে জিতিয়েছিলেন। এতটাই মানসিকভাবে শক্তিশালী মডরিচ। ছোটবেলার সেই লড়াই এই ছোট্ট চেহারার ছেলেটিকে এতটা শক্তিশালী করে তুলেছে। ফুটবলের বাইরে মডরিচ পুরোপুরি পরিবারে। ২০০৭এ স্ত্রী ভানজা বসনিকের সঙ্গে পরিচয়। ২০১০এ বিয়ে। এখন তাঁদের এক ছেলে ইভানো ও দুই মেয়ে এমা ও সোফিয়াকে নিয়ে সুখের সংসার।

ক্রোয়েশিয়া ফুটবল দল বিশ্বকাপ ফাইনালে নামার আগে।

মডরিচের যখন ১০ বছর বয়স তখন একাধিক ফুটবল কোচ তাঁকে ছেটে ফেলেছিল তাঁর রোগা চেহারা আর লাজুক স্বভাবের জন্য। এর র জাদারের ক্লাব কোচের জন্য ডায়নামো জাগরেবে ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগ চলে আসে মডরিচের সামনে। সেখান থেকেই শুরু হয় ফুটবলার হয়ে ওঠার অন্য এক লড়াই। আর এখন ক্লাব ও দেশের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারদের মধ্যে তিনি একজন। অল্পের জন্য বিশ্বকাপটা পাওয়া হল না। কেঁদে ফেলেছিলেন মডরিচ। তাই গোল্ডেন বল হাতে উৎসব করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর অধিনায়কত্বে ৫০ লাখ জনবসতির ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে ইতিহাস গড়েছে।