হাইমেনই কি সম্পর্কের একমাত্র হাইফেন!

খেলার মাঠেখেলার মাঠে

কুণাল দাশগুপ্ত: পল্লবীকে শেষ বার দেখা গিয়েছিল কোনও এক মানসিক হাসপাতালে। তার পর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই। তার চেতন ও মনের মতো সে-ও নিরুদ্দেশ। হয়তো বরাবরের জন্য।

কী হয়েছিল পল্লবীর? এক কথায়, ডানপিটে মেয়েটা ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল খেলত। কাপ, মেডেলের সঙ্গে এলাকার মানুষের কাছ থেকে বাছা বাছা বিশেষণও জুটেছিল তার জীবনে। হ্যাঁ, এই প্রগতির যুগেও! আর তাই ক্রমশ বেড়ে যাওয়া ‘ধিঙ্গিপনা’ রুখতেই পড়শিদের চাপে পড়ে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়ের পর সেই যে গেল পল্লবী, আর তার ফেরা হল না!

ফুটবল গেল, মন গেল, শরীর গেল, সংসার গেল। কোথায় যে হারিয়ে গেল পল্লবী!

ফুটবল মাঠে মেয়েরা

ফুটবল মাঠে মেয়েরা

শোনা যায়, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি। স্বামী ভদ্রলোকের সন্দেহ ছিল তাকে নিয়ে। পল্লবী নাকি তার শতচ্ছিন্ন চরিত্র নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল!

প্রমাণ ছিল কি?

নাহ‌্।

তবে?

আসলে ফুলশয্যার রাতে স্বামীর সঙ্গে প্রথম বার সঙ্গমের সময় তার যোনি থেকে এক ফোঁটাও রক্ত বেরিয়ে আসেনি। আর তাতে স্বামী নিশ্চিত হন, বিয়ের আগেই পল্লবীর সতীচ্ছদ ছিঁড়ে (হাইমেন র‌্যাপচার) গিয়েছে। চরিত্র খারাপ না হলে এমনটা কোনও মেয়ের হয় নাকি! কাজেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন, পল্লবীর চরিত্র আর যাই হোক, ভাল মোটেই নয়। সেখান থেকেই গঞ্জনার শুরু।

ফুটবল গেল, মন গেল, শরীর গেল, সংসার গেল। কোথায় যে হারিয়ে গেল পল্লবী!

মহিলাদের যোনিমুখে একটা পাতলা আবরণী থাকে। তাকেই হাইমেন বা সতীচ্ছদ বলে। প্রথম বার যৌন মিলনের সময় এই হাইমেন ছিঁড়েই যোনি থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে। বেশির ভাগ পুরুষের ধারণা, প্রথম বারের সঙ্গমে ওই রক্তপাত না হওয়া মানেই সেই নারী বিয়ের আগে অন্য কারও সঙ্গে সহবাস করেছেন। সেটা এক বা একাধিক বার হতে পারে। বিয়ের আগে অন্য সম্পর্কের জেরে হাইমেন ছিঁড়েছে অর্থাৎ সদ্য বিবাহিত পুরুষটি ওই নারীর জীবনে শারীরিক ভাবে প্রথম ব্যক্তি নন। এই ধারণা থেকেই নবদম্পতির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। শেষে ভাঙন! পল্লবীর যে কী হয়েছিল!

মেয়েরা খেলছে হকি

মেয়েরা খেলছে হকি

কিন্তু ঘটনা হল, বিয়ের আগে হাইমেন ছিঁড়ে যেতেই পারে। এবং মনে রাখা প্রয়োজন সেটা কোনও রকম সহবাস বা যৌন সংসর্গ ছাড়াই।

কী ভাবে?

অনেক বছর হয়ে গেল, আমাদের চেনা জগতে মেয়েরা নিজেরাই সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করে। নানা ধরনের খেলায় তারা অংশ নেয়। আর এ সবের সময় ছিঁড়ে যেতেই পারে যোনির ওই পাতলা আবরণীটি। তা ছাড়া, হাইমেনের ভিতর ছোট ছোট চিদ্র থাকে। মেয়েদের ঋতুচক্র বা পিরিয়ডের সময় ওই ছিদ্র দিয়েই রক্ত বেরিয়ে আসে। কোনও মেয়ের যদি সেই ছিদ্রটাই বড় হয়, তবে প্রথম বার কেন একাধিক বার যৌন মিলনেও হাইমেন না-ও ছিঁড়তে পারে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, ওই আবরণীতে রক্ত সরবরাহ তুলনায় কম হয়। তাই সহবাসের সময় তা ছিঁড়ে গেলে রক্তপাত যে হবেই, তারও কোনও মানে নেই। আর এ সবের সঙ্গে ওই মেয়েটির চরিত্রের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই কিন্তু।

লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে প্লেয়ারদের সার্জারি করতেই হবে

অথচ, বহু মেয়েকে বিয়ের পর আজও স্বামীর সঙ্গে প্রথম বার নিভৃত মিলনের জন্য আনন্দের পাশাপাশি একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করতে হয়। প্রশ্নগুলো মাথায় ঘোরে, পাতলা পর্দাটা ‘আমাদের মধ্যে পাঁচিল হয়ে দাঁড়াবে না তো’? তা হলে কি যন্ত্রণা পাওয়ার অভিনয় করতে হবে? বিছানায় লাগতেই হবে যোনি-রক্তের দাগ?

অ্যাথলিট মেয়ে

অ্যাথলিট মেয়ে

কেন না, আজও এই সমাজের একটা বড় অংশের কাছে, ওই রক্তের দাগই সদ্য বিবাহিত পুরুষটির বাড়িতে নতুন সদস্য হওয়া মেয়েটির সংশাপত্র!

পাতলা পর্দাটা ‘আমাদের মধ্যে পাঁচিল হয়ে দাঁড়াবে না তো’?

আজও আমরা মেয়েদের খেলতে পাঠাই। সুনামের সঙ্গে আমাদের মেয়েরা দেশ-বিদেশে খেলছে। সফল হচ্ছে। কিন্তু, প্রদীপের তলার অন্ধকারটা আরও গাঢ় হচ্ছে বোধহয়। বাস্তব এবং বিজ্ঞানটা যদি আরও একটু বুঝে দেখার চেষ্টা করতাম আমরা!

বাইপাসের ধারে স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সাই)-র সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থমকে যাই। মেয়েদের খেলতে দেখলে কোথাও একটা ‘ছ্যাঁৎ’ করে ওঠে! চেষ্টা করেও যে সরিয়ে ফেলতে পারি না, মনের ভিতর ভেসে ওঠা পল্লবীর মুখটা।

ছবি সৌজন্যে: হকি ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম ও অ্যাথলেটিক ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া