প্রণব মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে শেষ হল ভারতীয় রাজনীতির একটি অধ্যায়ের

প্রণব মুখোপাধ্যায়

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: প্রণব মুখোপাধ্যায় রেখে গেলেন একটা ইতিহাস, তাঁর সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতিতে শেষ হল একটা অধ্যায়ের। অগস্টের শেষ দিন বিদায় নিলেন তিনি। ১০ অগস্ট থেকে হাসপাতালে ছিলেন। ভেন্টিলেটরে রেখেই চিকিৎসা চলছিল। মাথায় রক্তক্ষরণের জন্য অস্ত্রোপচারও হয়েছিল তখনই কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে। সে কথা নিজেই জানিয়েছিলেন টুইট করে। তবে সেখান থেকে আর ফেরা হল না। ভারতীয় রাজনীতিতে প্রণব মুখোপাধ্যায় একটি বর্ণময় চরিত্র হয়ে থেকে যাবেন।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরিটি গ্রামে সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৯৩৫-এর ১১ ডিসেম্বর জন্ম প্রণববাবুর। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, মা রাজলক্ষ্মী দেবী। কামদাকিঙ্কর স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। দেশে স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদে কংগ্রেস সদস্যও হন দু’বার— ১৯৫২ এবং ১৯৬৪ সালে। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শুরু প্রণবের। তার পর বীরভূমেরই সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ। সেখান থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

একাধারে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসে এমএ, অন্য দিকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি। সব ক’টিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (ডাক ও তার)-এর অফিসে তিনি আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ১৯৬৩-তে তিনি কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে কাজে যোগ দেন। রাজনীতিতে ঢোকার আগে প্রণববাবু ‘দেশের ডাক’-এর সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন কিছু দিন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু সেই অর্থে বলতে গেলে ১৯৬৯ সালে। সে বার মেদিনীপুরে লোকসভার উপনির্বাচন। ওই উপ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন ভি কে কৃষ্ণমেনন। তাঁর ভোটপ্রচারে কাজ করেন প্রণব। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর নজরে পড়ে যান। ইন্দিরা এ বার প্রণবকে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়ান। এর পর প্রণব ওই বছরের জুলাইতেই রাজ্যসভার কংগ্রেস নির্বাচিত হন। রাজ্যসভায় তিনি পুনর্নির্বাচিত হন ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালে।

১৯৭৩ সালে প্রণববাবু ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় শিল্প মন্ত্রকের উপমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু জরুরি অবস্থা জারির কারণে ১৯৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যায় লোকসভায়। ফের ইন্দিরা ক্ষমতায় ফেরেন ১৯৮২ সালে। সে বার তিনি প্রণববাবুকে অর্থমন্ত্রী করেন। আর প্রণবের উত্থানের উল্কাগতির আর একটি পর্ব এখান থেকেই শুরু। ১৯৭৯-এ প্রণববাবু রাজ্যসভায় কংগ্রেসের  ডেপুটি দলনেতা। পরের বছরেই তিনি রাজ্যসভায় কংগ্রেসর দলনেতা হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান চির দিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই মনে রেখেছেন প্রণববাবু। আনুগত্য, দক্ষতা, বিশ্বস্ততায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন তিনি। ফলে ইন্দিরা সরকার এবং কংগ্রেসে তিনি ‘নম্বর টু’ হিসেবেই বিবেচিত হতেন। তাঁর কোনও সিদ্ধান্ত আসলে যে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা, এমনটাই বিবেচিত হত।

১৯৮৪তে ইন্দিরা হত্যার পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন। সেই সময় প্রণবের একটু ছন্দপতন। রাজীবের মন্ত্রিসভায় তিনি আর মন্ত্রীর নন। দলেও কিছুটা কোণঠাসা। ১৯৮৬ সালে প্রণববাবু কংগ্রেস ছেড়ে নিজেই একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। নাম দিলেন, রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। কিন্তু খুব সাফল্য তিনি পাননি। ফলে, ১৯৮৯-তে কংগ্রেসে তাঁর প্রত্যাবর্তন। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীও খুন হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন নরসিংহ রাও। প্রণববাবু আবার কংগ্রেসে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। সরকারেও। প্রথমে তৎকালীন যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান। তার পর প্রণব মুখোপাধ্যায় হলেন দেশের বিদেশমন্ত্রী। এ পর্যন্ত সবটাই রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে।

২০০৪-র নির্বাচনে লোকসভার ভোটে দাঁড়ালেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসন থেকে। জিতলেন। এর আগে ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালে মালদহ ও বোলপুর থেকে লোকসভায় দাঁড়িয়ে হেরে যান। ২০০৪-এ জিতে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতাও তখন প্রণব। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী যখন হতে চাইছেন  না, প্রণবই ছিলেন তখনও কমাত্র দাবিদার। কিন্তু শেষমেশ মনমোহন সিংহ হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রণব মুখোপাধ্যায় ফের দু’নম্বরে। পরের নির্বাচনে অর্থাৎ ২০০৯ সালেও ওই জঙ্গিপুর থেকেই জেতেন প্রণব। এই দফায় তিনি একের পর এক মন্ত্রকের দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সামলেছেন। প্রতিরক্ষা থেকে বিদেশ— সব।

কিন্তু সাংসদ পদের মেয়াদ শেষের আগেই প্রণবকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন  ইউপিএ জোট। প্রণব ২০১২-র ২৫ জুলাই ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এই প্রথম কোনও বাঙালি ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন। ২৫ জুলাই, ২০১৭ অবধি ছিল তাঁর রাষ্ট্রপতি থাকার মেয়াদ। এ দেশের সংবিধান অনুযায়ী  রাষ্ট্রপতি পদে একই ব্যক্তি পর পর দু’বার এবং প্রতি বার পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচনে লড়তে পারেন। কিন্তু ওই বছরের জানুয়ারিতেই প্রমব জানিয়ে দেন, তিনি আর রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচনে লড়তে চান না।

ভারতীয় রাজনীতিতে এবং কংগ্রেসে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন চাণক্য। ছোটখাটো চেহারার মানুষটিকে ভারতীয় রাজনীতি চিরকাল ‘মিস’ করবে।

(দেশের আরও খবরের জন্য এখানে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)