স্যামুয়েল হ্যানিম্যান দীর্ঘ সময় আর্থিক অনটনের মধ্যে কাটিয়েছিলেন

স্যামুয়েল হ্যানিম্যানস্যামুয়েল হ্যানিম্যান

স্যামুয়েল হ্যানিম্যান চিকিৎসা জগৎকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। হোমিওপ্যাথির আবিষ্কারক। কিন্তু তাঁর জীবনটা ঠিক কতটা কঠিন ছিল? জানুন হ্যানিম্যানের জীবনকাহিনি ডাঃ ধ্রুবজ্যোতি লাহিড়ির কলমে, আজ দ্বিতীয় পর্ব


স্যামুয়েল হ্যানিম্যান রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে লেখা প্রকাশ করতে শুরু করলেন। প্রকাশ পেল তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা— ‘কী ভাবে ক্ষত এবং ঘা সারানো যায়,  সে বিষয়ে নির্দেশনামা’। সঙ্গে চলতে থাকল বিভিন্ন বই অনুবাদের কাজও।

অন্য বিষয়ে জানার আগ্রহ ছিল হ্যানিম্যানের। বিশেষ করে রসায়ন শাস্ত্র। তাই তিনি রসায়নের প্রতি খুবই আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পারদকে অন্য ফর্মে এনে সলুবেল করে আবিষ্কার করলেন ‘মারকিউরিয়াস সলুবিলস’। তাঁর লেখা আর্টিকল অন ‘আর্সেনিক পয়সনিং’ গবেষণার জগতে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। রসায়নের জগতে তাঁর গবেষণা যথেষ্ট সাড়া ফেলে দেয়। তাঁর নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসি থেকে জার্মানে একাধিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেন। সে সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দি আর্ট অব ম্যানুফ্যাকচারিং কেমিক্যাল প্রোডাক্টস’, ‘দি আর্ট অব ডিসটিলিং লিকার্স’— দুটো বই দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

এই সময়ে কিছু দিন তিনি  টাউন হাসপাতালে চাকরি করেন। হঠাৎ ওই হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসক ওয়াগলার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুরো হাসপাতালের দায়িত্ব এসে পড়ে হ্যানিম্যানের উপর। প্রচুর রোগী দেখার পাশাপাশি তিনি দিনের পর দি‌ন বীতশ্রদ্ধ হতে থাকলেন তৎকালীন বিদঘুটে  আনাড়ি হ্যাপাজার্ড  চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে। মন থেকে তিনি সায় পাচ্ছিলেন না ওই বিষম চিকিৎসা পদ্ধতিতে।

মনের মধ্যে তাই অনবরত চিকিৎসা সংক্রান্ত নতুন কিছু উদ্ভাবনের স্বপ্ন ধীরে ধীরে বোনা হচ্ছিল। তিনি অনুভব করছিলেন, সারা দিন হাসপাতালে পড়ে থাকলে মনের ইচ্ছা পূরণ হবে না। ফলে, ছেড়েই দিলেন চাকরিটা। কিন্তু সংসার রয়েছে। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে! তাই তখন থেকেই রিসার্চের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনুবাদের কাজে হাত দেন। অবশ্যই বাড়তি উপার্জনের আশায়।

১৭৯০-এর এক দুপুরে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম কালেনের একটি  ইংরেজি মেটিরিয়া মেডিকার অনুবাদের কাজে হাত দিলেন হ্যানিম্যান। ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায়। এই বইয়ের একটি অধ্যয়ের পাদটিকায় লেখা ছিল— ম্যালেরিয়া জ্বরের ওষুধ কুইনাইন যদি কোনও সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা যায়, তবে অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর শরীরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে।

উইলিয়াম কালেনের এই অভিমত  হ্যানিম্যানের চিন্তা জগতে এক বিরাট আলোড়ন তৈরি করল। তিনি এর সত্যাসত্য পরীক্ষার জন্য নিজেই প্রতি দিন চার ড্রাম করে দিনে দু’বার সিঙ্কোনার রস খেতে আরম্ভ করলেন। এর তিন-চার দিন পরে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলেন। ম্যালেরিয়ার মতো কাঁপুনি দিয়ে জ্এবর আসে। পরিবারের প্রত্যেকের উপর তিনি এই একই পরীক্ষা করলেন এবং প্রতি বারই একই ফল!

এর থেকে তার মনে প্রশ্ন জাগে, কুইনাইনের মধ্যে কি তা হলে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ সৃষ্টিকারী কোনও ক্ষমতা আছে? যদি থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই অন্য সমস্ত ওষুধের মধ্যেও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ যে ওষুধ খেলে মানুষের কোনও রোগ নিরাময় হয়, সুস্থ দেহে সেই ওষুধ খেলে  নিঃসন্দেহে  সেই রোগ হয়।

এত দিন চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, বিরুদ্ধভাবাপন্নতাই বিরুদ্ধভাবাপন্নকে আরোগ্য করে। অর্থাৎ মানুষের দেহে অসুস্থ অবস্থায় যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায়, তার বিপরীত ক্রিয়াশক্তি সম্পন্ন ওষুধেই সেই রোগ আরোগ্য হয়। এই প্রচলিত মত তিনি খণ্ডন করতে চাইলেন। এই পুরনো মতের বিরুদ্ধে শুরু হল তার নতুন গবেষণা।

এমন সময়ে জার্মানির  ডিউক একটি মানসিক রোগের চিকিৎসালয় খোলার জন্য তার বাগানবাড়িটি হ্যানিম্যানকে ছেড়ে দিলেন। ১৭৯৩ সালে স্যামুয়েল হ্যানিম্যান সেখানে মানসিক রোগীদের জন্য একটি হাসপাতাল গড়ে তুললেন। একাধিক মানসিক রোগীকে সুস্থ করে তুলতে লাগলেন। সেই সময় মানসিক রোগীদের উপর কঠোর নির্যাতন করা হত। মনে করা হত, শারীরিক নির্যাতনই মানসিক রোগীদের চিকিৎসার প্রধান অঙ্গ। হ্যানিম্যান এই ভাবনা-চিন্তার প্রধান বিরোধী ছিলেন।

কিন্তু তাঁর গবেষণার কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। মানসিক হাসপাতালে সারাটা দিন নষ্ট হচ্ছে। তাঁর নিজের গবেষণাগারে পরীক্ষানিরীক্ষা  করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কিছু দিন মানসিক হাসপাতালে থাকার পর তিনি এই চাকরিটাও ছেড়ে দেন।

ইতিমধ্যেই তিনি আট সন্তানের বাবা। সংসারে দারুণ আর্থিক অনটন। কিন্তু তা সত্ত্বেও গবেষণার কাজে তিনি সামান্যতম বিঘ্ন ঘটাননি। এক দিকে যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন,  তেমন অন্য দিকে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজনে নিজেই বিভিন্ন রকমের ওষুধ খেতে থাকেন। এ কারণে বহু বার স্যামুয়েল হ্যানিম্যান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু গবেষণার কাজ কখনও থামিয়ে দেননি।

১৭৯০ থেকে ১৭৯৬— দীর্ঘ ৬ বছরের অক্লান্ত গবেষণার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সদৃশ যথার্থই সদৃশকে আরোগ্য করে। বিরুদ্ধভাবাপন্ন বিরুদ্ধভাবাপন্নতাকে আরোগ্য করে না। তাঁর এই ধারণা কোনও অনুমান বা কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এ সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো সত্যের এক স্বচ্ছ সরোবর।

(বিখ্যাত মানুষদের জীবন সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)