স্যামুয়েল হ্যানিম্যান আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে লিখে গিয়েছেন সেই কথাও

স্যামুয়েল হ্যানিম্যানস্যামুয়েল হ্যানিম্যান

স্যামুয়েল হ্যানিম্যান চিকিৎসাজগৎকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। হোমিওপ্যাথির আবিষ্কারক। কিন্তু তাঁর জীবনটা ঠিক কতটা কঠিন ছিল? জানুন হ্যানিম্যানের জীবনকাহিনি ডাঃ ধ্রুবজ্যোতি লাহিড়ির কলমে, আজ তৃতীয় পর্ব


স্যামুয়েল হ্যানিম্যান যে আবিষ্কার করেন, তা ১৭৯৬ সালে সে যুগের জার্মানির একটি বিখ্যাত পত্রিকা ‘হুফল্যান্ডস জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয়।  প্রবন্ধটির নাম দেওয়া হল: ‘অ্যান এসে অন আ নিউ প্রিন্সিপ্যাল ফর অ্যাসারটেনিং দ্য কিওরেটিভ পাওয়ারস অব ড্রাগস অ্যান্ড সাম এগজামিনেশন অফ দ্য প্রিভিয়াস প্রিন্সিপলস’।

এই প্রবন্ধের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন স্যামুয়েল হ্যানিম্যান । সেই কারণে ১৭৯৬ সালকে বলা হয় হোমিওপ্যাথির জন্মবর্ষ। হোমিওপ্যাথি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ হোমোস (Homoeos)  এবং প্যাথোস (Pathos) অর্থাৎ রোগ লক্ষণের সম লক্ষণ বিশিষ্ট ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা।

হ্যানিম্যানের এই যুগান্তকারী প্রবন্ধ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি হল। চিকিৎসাজগতের প্রায় সকলেই এই মতের ঘোরতর বিরোধী হয়ে উঠলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তীব্র সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে আরম্ভ হল। তাঁকে বলা হল, ‘অশিক্ষিত-হাতুড়ে চিকিৎসক’।

কিন্তু নিজের আবিষ্কৃত সত্যের প্রতি তার এতটা অবিচল আস্থা ছিল যে, কোনও সমালোচনাতে স্যামুয়েল হ্যানিম্যান সামান্যতম বিচলিত হলেন না। নিজের এবং আত্মীয়স্বজনের উপরে চালাতে থাকলেন বিভিন্ন ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাঁর মনে হয়েছিল, সুস্থ মানব দেহের উপর ওষুধ পরীক্ষা করেই তার ফল উপলব্ধি করা সম্ভব। ওষুধের মধ্যে যে আরোগ্যকারী শক্তি আছে, তা জানতে হলে সেই সব ওষুধ সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষা করতে হবে, এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সাধারণ পরীক্ষায় বা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে কোনও ওষুধের সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝা যেতে পারে, কিন্তু মানুষের উপরে কী ভাবে তা প্রতিক্রিয়া করবে তা জানবার জন্য মানুষের উপরে পরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।

এ ভাবে একের পর এক ওষুধ পরীক্ষা করে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করলেন, যা সিমপটমস সংগ্রহ করলেন, তার ভিত্তিতে বিভিন্ন বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়েও যে ২৭টি ওষুধ পরীক্ষা করতে পেরেছিলেন, ১৮০৫ সালে লাতিন ভাষায় তা প্রকাশ করলেন একটি বই আকারে। যার নাম দিলেন— ‘ফ্র্যাগমেন্টা ডে ভিরিবাস মেডিকা মেনটোরাম পজিটিভিস, সিভ ইন স্যানো করপোরা হিউম্যানো অবজারভেটিস’।এই বইটিকে তাই প্রথম হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা বা ভেষজ  লক্ষণ সংগ্রহ বলা যেতে  পারে। এর পর থেকে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আরম্ভ করলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর পরীক্ষিত সত্যকে যত ক্ষণ না রোগীর চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করছেন তত ক্ষণ পর্যন্ত  তা জনগণের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে সক্ষম হবে না। এই সময় তাঁকে রোগী দেখা, চিঠিপত্র লেখা, গবেষণার কাজ এবং বই লেখার জন্য পরিশ্রম করতে হত।

প্রতি দিন ভোর ছ’টায় তিনি ঘুম থেকে উঠতেন। সকালের জলখাবার ছিল, দু’কাপ দুধ। তার পর কিছু ক্ষণ বাগানে পায়চারি করে চেম্বারে চলে যেতেন। দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে খাওয়া সেরে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। তাঁর এই বিশ্রামের সময়টুকু কড়া পাহারায় রাখতেন তাঁর মেয়েরা। কারণ, সামান্য সময় পেলেই আবার চিঠিপত্র লেখার কাজ শুরু করে দিতেন। অল্প কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আবার রোগী দেখতে চলে যেতেন। সন্ধ্যা অবধি চলত তাঁর রোগী দেখা। তার পর বাড়ি ফিরে এক কাপ গরম দুধ আর রাতের খাওয়া সেরে চলে যেতেন পড়ার ঘরে। মধ্য রাত, কোনও কোনও সময় শেষ রাত অবধি চলত  চিঠিপত্র, বই লেখা এবং ওষুধ বানানোর কাজ।

১৮১০ সালে প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত বই ‘অর্গানন অব মেডিসিন’। এই বইকে বলা হয় হোমিওপ্যাথির বাইবেল। এই বইতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির নীতি  ও বিধান সমূহের  বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর অকাট্য যুক্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন তাঁর প্রতিটি অভিমত। এই বইয়ে  হোমিওপ্যাথিক মূলনীতির আলোচনা ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা প্রণালী আলোচনা করে তিনি হোমিওপ্যাথির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ ছাড়াও সে যুগে চিকিৎসার নামে যে ধরনের কার্যকলাপ প্রচলিত ছিল, তাঁর বিরুদ্ধেও তিনি  তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন।

১৮১০ সালের এপ্রিল মাসে ‘অর্গানন অব মেডিসিন’ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল সমালোচনা আর বিতর্কের ঝড় বইতে আরম্ভ হল। তাঁর উপর শুরু হল নানা রকম মানসিক নির্যাতন।

তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হতে থাকল, বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালের মাধ্যমে। বই লিখে, প্যামফ্লেট বা ছোট ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করে, গ্রামেগঞ্জে টিন বাজিয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে করা হল সমালোচনা। ১৮১০ সালের জুন মাস থেকে ডাঃ হেনরো নামে এক ব্যক্তি মাসিক জার্নাল বার করা শুরু করে দিলেন, নাম ‘আন্টি অর্গানন’। ডাঃ সিমসন নামে এক চিকিৎসক আরও একটি জার্নাল বার করা শুরু করে দিলেন, ‘অ্যান্টি হোমিওপ্যাথিক আর্কিভ’ নামে। হুফল্যান্ড, যিনি একদা তার প্রিয় বন্ধু ছিলেন, যাঁর ম্যাগাজিনেই তিনি ১৭৯৬ সালে ‘অ্যান এসে’ লিখেছিলেন, তিনি এখন তাঁর জার্নালের প্রতিটি সংখ্যায় হ্যানিম্যানকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করতে লাগলেন।

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেকার সাহেব ১৮১৯ সালের জুলাই মাসে ১০০ পৃষ্ঠার উপরে একটি বই বার করলেন— স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ও হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে। দেমাকি নামে এক জন বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ, যাঁর রসায়ন শাস্ত্রের বই হ্যানিমান মাত্র ২১ বছর বয়সে জার্মান ভাষায় অনুবাদ এবং পরিমার্জিত-পরিবর্ধিত করে দেমাকের কাছ থেকে ভীষণভাবে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন, তিনি লিখলেন— ‘‘এই লোকটার রসায়ন শাস্ত্রে যা দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য ছিল তাতে তিনি হতে পারতেন বড় এক রসায়নবিদ! কিন্তু কী দূর্ভাগ্য, তিনি এক হাতুড়ে ডাক্তারের ভূমিকায় নিজেকে নামিয়ে  নিয়ে গেলেন।’’

অ্যাপোথিকারী গিল্ড নামে জার্মানির কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে আবেদন জানাল— ওই ছিটিয়াল, মূর্খ, অসভ্য লোকটার অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা ও কাজকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। গভর্নর তাঁদের কথা শুনলেন এবং হ্যানিম্যান ও তাঁর ৬ ছাত্রকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরি ও বিতরণ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। সব ছাত্রদের ওষুধ এবং ওষুধ বানানোর সরঞ্জাম সরকারি তত্ত্বাবধানে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল। এক জন ছাত্রের জেল হল।

১৮২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হ্যানিমানকে সশরীরে লিপজিক কোর্টে হাজিরা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে বলতে বলা হল।

স্যামুয়েল হ্যানিম্যান জানতেন, যাঁরা নতুন কিছুর আবিষ্কারক তাঁদের সকলকেই এই ধরনের অত্যাচার সইতে হয়। এই ব্যাপারে তিনি প্রথম ব্যক্তি নন, শেষ ব্যক্তিও নন। নিজের উপর তার এতখানি আত্মবিশ্বাস ছিল যে, ১৮১৯ সালে যখন তিনি অর্গাননের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত করেন, বইয়ের প্রথমেই  লিখলেন, অড স্পেয়ার, যার  অর্থ— আমি নিজেকে সাহসী বলে ঘোষণা করছি, সত্যের জন্য আমি নির্ভীক। এই ভাবে তিনি তৎকালীন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাবে অথচ শালীনতা বজায় রেখে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

হ্যানিম্যানের জীবদ্দশায় অর্গাননের আরও চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিটি সংস্করণে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত থেকে উন্নততর রূপে নিয়ে যাওয়ার থিওরি দিয়েছেন।

(বিখ্যাত মানুষদের জীবন সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)