ইন্দিরা গান্ধী: একটি রাজনৈতিক হত্যা এবং শিখবিরোধী দাঙ্গার ৩৪ বছর

Indira Gandhiইন্দিরা গান্ধী

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এমন বর্ণময় ব্যক্তিত্ব সত্যিই বড় কম। ঠিক ৩৪ বছর আগে এমনই এক অক্টোবরের সকালে তিনি নিজের দেহরক্ষীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। ইন্দিরা-হত্যার সেই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় লাল কালিতে লেখা রয়েছে।

৩১ অক্টোবর ১৯৮৪। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে তাঁরই দুই দেহরক্ষী। দু’জনেই শিখ। ওই দু’জনের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা। মারা গিয়েছিলেন। আর সেই  ঘটনার পরেই দিল্লিতে শুরু হয় শিখ বিরোধী দাঙ্গা। যা কেড়ে নিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ।

আগের দিন অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় ওড়িশার ভুবনেশ্বরে সভা করেছিলেন ইন্দিরা। সেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আজ এখানে আছি, হয়তো আগামিকাল এখানে থাকব না… যে দিন আমি মারা যাব, আমার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু ভারতকে প্রাণবন্ত এবং শক্তিশালী করবে।’ তখনও কি তিনি জানতেন, এক দিন পরেই গোটা দেশের সংবাদপত্রগুলির শিরোনাম হবে, ‘দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত ইন্দিরা গান্ধী’!

ইন্দিরার পরনে জাফরানি রঙের কালো পাড়ের শাড়ি। পাতলা ছিমছাম প্রধানমন্ত্রীর পায়ে কালো রঙের চমৎকার চটি। কাঁধে এমব্রয়ডারি করা লাল রঙের একটা ব্যাগ। দেখতে বেশ ভালই লাগছে।

ইন্দিরা গান্ধী

১ নভেম্বর ১৯৮৪-এর সংবাদপত্র

৩১ তারিখ সকালটা খুব রোদ ঝলমলে ছিল। দিল্লির বাতাসে ছিল ঠান্ডা হাওয়া। গোটা দিনটাই ইন্দিরা গান্ধীর ঠাসা কর্মসূচি। সকালে আকবর রোডের বাড়িতে টেলিভিশ-সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ব্রিটিশ অভিনেতা-কলমচি পিটার উস্তিনভকে। টিম-উস্তিনভ তাঁর জন্য সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিল। দুপুরে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাঘনের সঙ্গে বৈঠক এবং রাতে ব্রিটেনের রাজকুমারী অ্যানের সম্মানে নৈশভোজ। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন ইন্দিরা।

অর্ধ শতাব্দী পরেও রহস্যে মোড়া লালবাহাদুরের মৃত্যু

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তাঁকে রোজ সকালে দেখতে আসতেন চিকিৎসক কৃষ্ণপ্রসাদ মাথুর। সে দিনও তিনি এসেছিলেন। কোনও দিনই তাঁদের মধ্যে রোগ নিয়ে কথা হত না। সে দিনও হয়নি বলেই পরে জানিয়েছিলেন ডাক্তার মাথুর। মাঝে মাঝেই নাকি ডাক্তার মাথুরে ইন্দিরা বলতেন, ‘আমি হঠাৎ করেই দেখবেন এক দিন মারা যাব। কোনও দুর্ঘটনায়।’

সবে সকাল ৯টা বেজেছে। ইন্দিরা ১ নম্বর সফদরজং রোডের বাসভবন থেকে বেরিয়ে গা লাগোয়া ১ আকবর রোডের অফিস বাংলোয় যাবেন। সেখানেই টিম-উস্তিনভ অপেক্ষা করছে। ইন্দিরা ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটছেন, এক জন পুলিশ কনস্টেবল ছাতা বার করে ধরলেন প্রধানমন্ত্রীর মাথায়। তাঁর পিছনেই রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব রাজিন্দর কুমার ধাওয়ান।

ইন্দিরা গান্ধী

১ নম্বর সফদরজঙ রোডের সেই বাসভবন। এখন ইন্দিরা মিউজিয়াম।

ইন্দিরার পরনে জাফরানি রঙের কালো পাড়ের শাড়ি। পাতলা ছিমছাম প্রধানমন্ত্রীর পায়ে কালো রঙের চমৎকার চটি। কাঁধে এমব্রয়ডারি করা লাল রঙের একটা ব্যাগ। দেখতে বেশ ভালই লাগছে। ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দেবেন, নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন ইন্দিরা।

দুই বাড়ির মধ্যে ছোট্ট একটা কাঠের গেট। সেটা পেরোতে যাবেন ইন্দিরা, সেই সময় এগিয়ে এলেন বিয়ন্ত সিং নামে তাঁর পুরনো এক দেহরক্ষী। প্রায় ৯ বছর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করছে বিয়ন্ত। বিদেশেও গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তার কিছু দিন আগেই লন্ডন গিয়েছে। অপারেশন ব্লু স্টারের পর বিয়ন্তকে শিখ হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু, ইন্দিরা সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়ে বিয়ন্তকে বহাল রেখেছিলেন। সেই বিয়ন্ত এগিয়ে এসেই সরাসরি ইন্দিরার দিকে তার রিভলভারটি তাক করে। ইন্দিরা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী করছো এটা?’’

ইন্দিরা গান্ধী

গান্ধীজির সঙ্গে ছোট্ট ইন্দিরা

বিয়ন্ত কোনও কথা না বলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পর পর পাঁচ বার গুলি চালালো ইন্দিরাকে লক্ষ্য করে। এর পরেই লনের ও পাশ থেকে সৎবন্ত সিং এগিয়ে এল। বাইশ বছরের তরতাজা শিখ যুবক। প্রধানমন্ত্রীকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে একটু হতচকিত হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু, সেই হতচকিত ভাব কাটিয়ে দিল বিয়ন্তের চিৎকার, ‘শুট’। পর পর ২৫ রাউন্ড গুলি ছুটল সৎবন্তের স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান থেকে।

গুলির সাইক্লোন জাঁঝরা করে দিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। শরীরের সব অংশেই গুলি লাগে। জাফরান রঙা শাড়িটা ভিজে লাল হয়ে যায় রক্তে। ছুটে এগিয়ে আসেন ধাওয়ান। অন্য রক্ষীরাও ছুটে আসেন ইন্দিরার কাছে। বিয়ন্ত-সৎবন্ত তত ক্ষণে তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র ফেলে দিয়েছে। অন্য নিরাপত্তারক্ষীদের সে পাঞ্জাবিতে বলে, ‘‘আমাদের যা করার আমরা করেছি। এ বার তোমাদের যা করার তা করো।’’ ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইন্দো-তিব্বতীয় বর্ডার পুলিশ তত ক্ষণে ঘিরে ফেলেছে ওই দুই নিরাপত্তারক্ষীকে।

ইন্দিরা গান্ধী

দুই ছেলে রাজীব এবং সঞ্জয়ের সঙ্গে মা ইন্দিরা।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সব সময়ে একটি অ্যাম্বুল্যান্স থাকে। তার চালক সেই সময়ে চা খেতে বাইরে গিয়েছিল। তাই একটি অ্যাম্বাসাডরে করে ইন্দিরাকে নিয়ে যাওয়া হয় এইমস-এ। গাড়িতে ছিলেন, রাজিন্দর কুমার দাওয়ান, সনিয়া গান্ধী এবং আর এক নিরাপত্তারক্ষী দীনেশ ভাট। সকালের দিকে রাস্তায় বেশি ভিড় ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইন্দিরাকে নিয়ে তাঁরা পৌঁছে যান। রক্ত, অক্সিজেন, অস্ত্রোপচার— কোনও কিছুতেই আর সাড়া দেননি ইন্দিরা।

দুপুর ২টো ২০ মিনিট নাগাদ চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, মারা গিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। ৬৭তম জন্মদিনের কয়েক দিন আগে এ ভাবেই হত্যা করা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে।

উস্তিনভ পরে বলেছিলেন, তিনি প্রথমে তিনটি গুলির আওয়াজ শুনেছিলেন। পর মুহূর্তেই তাঁর মনে হয়েছিল, কাছেই কোথাও যেন টানা বাজি ফাটছে। বিয়ন্ত সিংকে ঘটনাস্থলেই গুলি করে মারা হয়। গুলি করা হলেও বেঁচে যায় সৎবন্ত সিং। ঘটনার প্রায় চার বছর পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার দায়ে সৎবন্ত এবং অন্য এক ষড়যন্ত্রকারী কেহর সিংয়ের ফাঁসি হয়।

কিন্তু, ৩১ অক্টোবরের সেই রাজনৈতিক হত্যা আরও এক হত্যালীলার জন্ম দিয়েছিল। বিয়ন্ত-সৎবন্তরা শিখ হওয়ায় রাজধানী জুড়ে শিখবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। যার আঁচ পড়ে গোটা দেশেই।