ভারত-পাক ফুটবলের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’

মাসুদ ফাকরি।

টোবা টেক সিং। শব্দ তিনটি অমর হয়ে রয়েছে উর্দু সাহিত্যে। শুধু উর্দু নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও নিজের পাকাপোক্ত জায়গা ওরা করে নিয়েছে সাদাত হাসান মান্টোর সৌজন্যে। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মান্টোর লেখা ছোটগল্প ‘টোবা টেক সিং’। ভুবন বিখ্যাত ওই গল্প গোটা দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় পঞ্জাব প্রদেশের ছোট্ট ওই শহরের।

কিন্তু তারও বছর তিনেক আগে, ওই শহর থেকে এক ‘জাদুকর’ এসে মাতিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা শহর। পায়ে ফুটবলের জাদু নিয়ে। তাঁর নাম মাসুদ ফাকরি। আন্তর্জাতিক ফুটবলার। এই শহরে এসে তিনি ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান— দু’দলেই চুটিয়ে খেলেছেন। গোল করেছেন। একের পর এক কাপ দিয়েছেন। বছর চারেক পর এই শহর থেকেই উড়ে গিয়েছিলেন ব্রিটেনে, ব্রাডফোর্ড সিটি ক্লাবে খেলতে। সেখানে একটা মরসুম খেলার পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন।

এমনিতে ফিফা র‌্যাঙ্কিং-এ পাকিস্তান প্রায় ২০০-র কাছাকাছিতে রয়েছে। সে দেশের ফুটবল ইতিহাস খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। ফুটবলের চেয়ে কয়েক শো গুণ বেশি-ই তার ক্রিকেটে মন। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যা টানাপড়েন, খেলাধুলোর স্তরেও এখন প্রায় মুখ দেখাদেখি হয় না বললেই চলে। এমনটা কিন্তু সেই সময়ে ছিল না। দেশভাগ পরবর্তী কয়েক বছরে কিন্তু পাকিস্তানের ফুটবলাররা এ দেশে এসে খেলে গিয়েছেন। মাসুদ ফাকরি তার অন্যতম উদাহরণ।

সেটা ১৯৫২ সাল। পাকিস্তান থেকে সোজা কলকাতায় এসে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে সই করেন মাসুদ। সমর্থকদের একটা অংশের ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল ২০ বছরের ওই যুবকের আগমনে। তার আগে তিনি পাকিস্তানের রাইডার্স ক্লাবে খেলতেন। কিন্তু কলকাতার ফুটবল সমর্থকরা তাঁকে প্রায় চিনতই না! ইস্টবেঙ্গলে তাঁর আগেও পাকিস্তানি ফুটবলার খেলেছেন। ’৪৯ সালে তাজ মহম্মদ নামে এক খেলোয়াড় ইস্টবেঙ্গলে সই করেছিলেন। ওই বছর আরও তিন জন পাক খেলোয়াড় খেলেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। দেশভাগের ক্ষত কিন্তু তখনও দগদগে!

ইস্টবেঙ্গলে এসেই কাঁপিয়ে দিলেন মাসুদ। কলকাতা ফুটবল লিগ জিতে নিল ইস্টবেঙ্গল। শুধু তাই নয়, ডুরান্ড কাপ এবং ডিসিএম ট্রফিও। আর তিনটি জয়ের পিছনে মূল কারিগরের নাম কিন্তু মাসুদ ফাকরি। এশিয়ার সব থেকে পুরনো টুর্নামেন্ট ‘দুরান্ড’ কাপ সেই সময়ে ফুটবল ক্লাবগুলোর পাখির চোখ ছিল। জাতীয় ফুটবল ক্যালেন্ডারে একেবারে লালকালিতে দাগানো থাকত।

ইস্টবেঙ্গলের মন জিততে পাকিস্তানি ওই ফরোয়ার্ডের এক ফোঁটাও সময় লাগেনি। ওই সময় পর পর দুটো ডার্বিতে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে একটি করে গোল পেয়েছিলেন মাসুদ। আর ফলাফল? দুটো ম্যাচেই ১-০। কাজেই চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানকে ডার্বিতে দু’বারই হারতে হয়েছিল মাসুদের জন্যই। তার মাত্র কয়েক বছর আগে দেশভাগ হয়েছে। ১৯৪৬-এর কলকাতা দাঙ্গার কথাও ভুলে যায়নি কেউ। কিন্তু, পাকিস্তানের ছেলে মাসুদ শহরের ‘হিরো’ বনে গিয়েছিল। কলকাতা ও শহরতলির একটা অংশ তো রীতিমতো তাঁকে নিয়ে উৎসবে মেতে গিয়েছিল। পুরনো ক্ষত অনেকটা মিলিয়ে দিয়েছিল ফুটবল।

’৫২-র পর আরও দুটো মরসুম ইস্টবেঙ্গলে খেলেছিলেন মাসুদ। ১৯৫৩-তে তিনি সিনিয়র টিমের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন রোমানিয়া ইউথ ফেস্টিভ্যালে, বুচারেস্ট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে।

এর পর ১৯৫৫তে ফাকরি সই করেন কলকাতারই আর এক নামজাদা ক্লাব মহামেডান স্পোর্টিং-এ। ১৯৫৬তে মহামেডানকে তিনি রোভার্স কাপ এনে দেন। এর মধ্যেই মাসুদ পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। তাঁর পায়ের জাদুতে ১৯৫৪-য় সিঙ্গাপুরকে ৬-২ গোলে এশিয়ান গেমসে হারায় পাকিস্তান। ভারত এবং মায়ানমারের বিরুদ্ধেও গোল করেছিলেন মাসুদ।

১৯৫৬তে ফাকরি চলে গেলেন ইংল্যান্ডে, ক্লাব ফুটবল খেলতে। সই করলেন ব্রাফোর্ড সিটিতে। এক বছর সেখানে চুটিয়ে খেলেন। ১৯৫৭তে ওই ক্লাব থেকে অবসর নেন। বিদায় জানান ফুটবলকে। আর পা রাখেননি মাঠে। তার পর থেকে তিনি থাকতেন ইংল্যান্ডের ওয়েলসে। সেখানেই ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান মাসুদ ফাকরি।

মান্টোর গল্পে বিষেণ সিং বেদী নামে এক পাগলের কথা বলা হয়েছিল। সে লাহৌরের একটি পাগলা গারদে ছিল। দেশভাগের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, হিন্দু পাগলদের পাঠানো হবে ভারতে। আর পাকিস্তানে রেখে দেওয়া হবে মুসলমান পাগলদের। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই বিষেণ সকলকে জিজ্ঞেস করতেন, টোবা টেক সিং কোন দেশের ভাগে পড়েছে— ভারত না, পাকিস্তান? জবাব পাননি তিনি। অথচ টোবাটেক সিং কিন্তু পাকিস্তানেই পড়েছিল। পরে যখন তাকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হল, ভারতে পাঠানো হবে বলে, দেখা গেল, নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়েই মারা গেলেন বিষেণ। তাঁকে আর ভিন্‌দেশে যেতে হয়নি। থেকে গিয়েছিলেন নো ম্যানস ল্যান্ডেই।

ঠিক ওই গল্পের মতোই ভারত-পাক ফুটবল ইতিহাসে নো ম্যানস ল্যান্ড হয়ে রয়ে গিয়েছেন মাসুদ ফাকরি। তাঁর ফুটবলের জাদুর কারণে।