অর্ধ শতাব্দী পরেও রহস্যে মোড়া লালবাহাদুরের মৃত্যু

ভারতের প্রথম যে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে মারা গিয়েছিলেন, তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রী। জওহরলাল নেহরুর পর তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু, দায়িত্ব নেওয়ার দু’বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও সেই মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা ছড়িয়েছিল সেই সময়ে। আজও যে সে সব রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, এমনটা নয়।

১৯৬৪ সালের ৯ জুন লালবাহাদুর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন। তার ঠিক কয়েক দিন আগেই ২৭ মে জওহরলালের মৃত্যু হয়। দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস কর্মী এবং জওহরলালের মন্ত্রিসভার সদস্য লালবাহাদুর সম্পর্কে দলের মনোভাব ভালই ছিল। কিন্তু, গোল বাধে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। জওহর-কন্যা ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গেও তাঁর ভাল সম্পর্ক ক্রমে কেবল সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছিল বলে শোনা যায়।

১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাসখন্দ চুক্তি সম্পন্ন করতে সেখানে গিয়েছিলেন লালবাহাদুর। আর সে মাসের ১১ তারিখ রাতে হোটেলের ঘরেই তাঁর মৃত্যু হয়। সরকারি ভাবে জানানো হয় তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। কিন্তু, তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই মৃত্যুর পিছনে রহস্য আছে বলে দাবি করেন। আজও সেই দাবি থেকে তাঁরা সরে আসেননি। বারে বারেই তাঁরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু-রহস্যের ‘গোপন’ ফাইল প্রকাশের দাবি তুলেছেন। তাঁর ছেলে অনিল শাস্ত্রী বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা। অনিলও তাঁর বাবার মৃত্যুর পিছনে রহস্য আছে বলে বারে বারেই দাবি করেছেন।

বছর দুয়েক আগেও তিনি সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবার দেহ যখন দিল্লি বিমানবন্দরে নামানো হয় তখন গোটা শরীরটা নীল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। লালবাহাদুরের মুখটা পর্যন্ত নীল হয়ে গিয়েছিল। কপালের দু’পাশে স্পষ্ট সাদা ছোপও দেখেছিলেন অনিল। তাঁর মা ললিতাদেবী নাকি তখনই বলেছিলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।

৬১ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালের ২ অক্টোবর। উত্তরপ্রদেশের মুঘলসরাইতে লালবাহাদুরের মামারবাড়িতেই জন্ম হয় তাঁর। লালবাহাদুরের বাবা সারদাপ্রসাদ শ্রীবাস্তব ছিলেন বারাণসীর কাছে রামগড়ের একটি স্কুলের শিক্ষক। পরে তিনি ইলাহাবাদে রাজস্ব দফতরের কর্মী হিসাবে কাজে যোগ দেন। ছেলের এক বছর বয়স যখন, তখনই সারদাপ্রসাদের মৃত্যু হয়। এর পর ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে মুঘলসরাইতে চলে আসেন লালবাহাদুরের মা রামদুলারিদেবী।

লালবাহাদুর প্রথমে মুঘলসরাইয়ে পূর্ব-মধ্য রেলের আন্ত-কলেজে এবং পরে বারাণসীতে হরিশচন্দ্র হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে গাঁধীজি বারাণসীতে উচ্চশিক্ষার জন্য কাশী বিদ্যাপীঠের উদ্বোধন করেন। সেই বিদ্যাপীঠেরই প্রথম পর্য্যায়ের ছাত্র লালবাহাদুর। প্রথম শ্রেণীর স্নাতক হওয়ার পর বিদ্যাপীঠ তাঁকে শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত করে। সেই থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে শাস্ত্রী জুড়ে যায়। আর কখনও তিনি শ্রীবাস্তব বা কায়স্থ হিসাবে বর্মা পদবী ব্যবহার করেননি। এরই পাশাপাশি কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়া। গাঁধীজি এবং জওহরলালের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা। শেষে জওহরলালের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নেওয়া।

কিন্তু, মৃত্যু নিয়ে এত জলঘোলা বোধহয় আর কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে হয়নি। অনিল শাস্ত্রী যেমন দাবি করেছেন, ‘‘আমিও ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যে বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। খুব জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু মনে হয় তদন্তে যথেষ্ট গাফিলতি হয়েছে। কেউই তো শাস্তি পায়নি।’’

কেন স্বাভাবিক নয়? অনিলের দাবি, তাঁর বাবা নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেখানে অনেক খুঁটিনাটি কথা লেখা থাকত। কিন্তু লালবাহাদুরের মৃত্যুর পর থেকে ওই ডায়েরিরও কোনও হদিশ মেলেনি। যেমন খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর সঙ্গে যে ফ্লাস্কটি ছিল সেটিরও। হতে পারে সেখানেই এমন কিছু মেশানো হয়েছিল যার জেরে লালবাহাদুরের মৃত্যু হয়। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং সচিবও দুর্ঘটনার শিকার হন। ওই দু’জনকেও তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল। দু’-দু’বার এমন সমাপতন খুবই আশ্চর্যজনক বলে মত অনিলের।

ওই ঘটনার পর তাসখন্দের হোটেলে লালবাহাদুরের যে খানসামা ছিল, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনিও ছাড়া পেয়ে যায়। পরে অনিলের মা তাসখন্দে গিয়ে সেই খানসামার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁকে নাকি জানানো হয়, ওই খানসামাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেলে লালবাহাদুর যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরে তাঁর খাটের পাশেই একটা ছোট্ট টেবিলে সেই রাতে রাখা ছিল একটা থার্মোফ্লাস্কও। অনিলের কথায়, ‘‘বাবার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার আর এন চুঘ রাতে বাবাকে দেখতে গিয়ে টেবিলে ওই থার্মোফ্লাস্কটি দেখেছিলেন। বাবার রাতে গরম দুধ খেয়ে ঘুমোনোর অভ্যাস ছিল। হয়তো সেই জন্যই ওই থার্মোফ্লাস্কটি রাখা হয়েছিল। কিন্তু, ওই থার্মোফ্লাস্কটিরও আর হদিশ পাওয়া যায়নি। তাই, ওই থার্মোফ্লাস্কে দুধই ছিল নাকি অন্য কিছু, এখনও পর্যন্ত আমরা তা জানতে পারিনি। আমার তো মনে হয়, বাবার মৃত্যু-রহস্যের কারণ লুকিয়ে রয়েছে ওই থার্মোফ্লাস্কেই!’’

নিয়মিত ডায়েরি লেখারও অভ্যাস ছিল প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর। অনিল বলেছেন, ‘‘বাবার সেই ডায়েরিও পরে আর পাওয়া যায়নি। ওই দিনই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বড় একটি চুক্তি হয়েছিল। বাবা হয়তো সেই চুক্তির কথা তাঁর ডায়েরিতে লিখেও রেখেছিলেন। কিন্তু, কী লিখেছিলেন, তা আজও আমরা কেউ জানতে পারিনি।’

প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পর শাস্ত্রীজির মৃত্যু-সংক্রান্ত ‘গোপন’ ফাইলগুলি কি এ বার আসবে প্রকাশ্যে? লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নাতি তথা বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ফাইলগুলি প্রকাশ্যে আনার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীর দ্বারস্থ হবেন তিনি। তাঁর আশা, মোদী নিশ্চয় তাঁর পরিবারের আর্জি মেনে নেবেন। বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত ফাইল প্রকাশ্যে আনা উচিত বলে মনে করেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর আর এক ছেলে তথা বিজেপি নেতা সুনীল শাস্ত্রীও।