সতীত্ব প্রমাণের রীতি, শরীরের সঙ্গে মানসিক ভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে মেয়েরা!

সতীত্বপ্রতিবাদে সরব মেয়েরাই...

শুচিস্মিতা সেন চৌধুরী
(অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, মৃণালিনী দত্ত মহাবিদ্যাপীঠ)


সতীত্ব এবং তার আবার পরীক্ষা! নববধূ ‘ভার্জিন’ অর্থাৎ কুমারী কি না, বিয়ের দিনই তার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এবং সেটা এই ২০১৮ সালের ভারতে!

সম্প্রতি খবরের শিরোনামটা পড়ে প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম, ‘দ্য হিউমিলিয়েটিং ভার্জিনিটি টেস্টস ফর ব্রাইডস, আ রিয়ালিটি ইন ইন্ডিয়াস কাঞ্জারভাট কমিউনিটি’। কাঞ্জারভাট সম্প্রদায় এই ভারতেই বাস করেন। দীর্ঘ দিন আগে তারা রাজস্থান থেকে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। ওই সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিয়ের ঠিক পর পরই এমন নিয়ম! মেয়েদের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হবে! এবং সেই পরীক্ষার ফল দেখে তবেই বিয়েতে চূড়ান্ত সম্মতি দেবেন মোড়লরা! যদি মেয়েটি পাশ করেন, তবেই বিয়ে মঞ্জুর। আর ফেল করলে? ধরে নেওয়া হবে, ওই মেয়েটির সঙ্গে অন্য কারও বিয়ের আগে থেকেই যৌন সম্পর্ক ছিল।

প্রথম বারের সঙ্গমে সতীচ্ছদ ছিঁড়ে বিছানা যদি রক্তে ভিজে যায়, তবেই পাশ করলেন মেয়েটি। এর পর সেই রক্তের দাগ লাগা চাদর সম্প্রদায়ের মোড়লদের দেখাতে হবে।

কিসের ভিত্তিতে পাশ-ফেল নির্ধারিত হবে? ওই খবর পড়ে জানা গিয়েছে, বিয়ের দিন রাতেই নতুন বউকে সাদা চাদর পাতা বিছানায় শুতে হয়। তার পর যৌনাচার। প্রথম বারের সঙ্গমে সতীচ্ছদ ছিঁড়ে বিছানা যদি রক্তে ভিজে যায়, তবেই পাশ করলেন মেয়েটি। এর পর সেই রক্তের দাগ লাগা চাদর সম্প্রদায়ের মোড়লদের দেখাতে হবে। তাঁরা এর পর বিয়েতে সিলমোহর দেবেন। কিন্তু, রক্ত যদি না বেরোয়? তা হলে কুমারীত্বের পরীক্ষায় ডাহা ফেল করবেন ওই মেয়েটি। এবং সে ক্ষেত্রে বিয়ে ভণ্ডুল হয়েও যেতে পারে। সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েতে জরিমানা দিয়ে রেহাই মিললেও মিলতে পারে। তবে, ওই পরিবারের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ছিন্নই করে দেয় সমাজ!

সতীত্বের পরীক্ষা! নারীর প্রতি অসম্মান।

সতীত্বের পরীক্ষা! নারীর প্রতি অসম্মান।

কেন বিয়ের পর একটি মেয়েকে এমন একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে? আসলে এটি একটি সামাজিক প্রথা। কাঞ্জারভাট সম্প্রদায়ের বর্তমান প্রজন্ম যার নাম রেখেছে ‘ভি-রিচুয়াল’। এই সম্প্রদায় একটা সময় ছিল যাযাবর। তাদের সমাজ এই প্রাচীন রীতি এখনও বর্জন করতে পারেনি। অনেক আদিবাসী এবং জনজাতিদের মধ্যেও এমন ধরনের রীতি আছে। এমন উদাহরণ যেমন এ দেশে রয়েছে, তেমন বিদেশের বহু জায়গায়তেও মেয়েদের এমন সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে আজও। অনেক জায়গায় প্রাচীন এই রীতি আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিতও হয়েছে।

কাঞ্জারভাট সম্প্রদায়ের বর্তমান প্রজন্ম যার নাম রেখেছে ‘ভি-রিচুয়াল’। এই সম্প্রদায় একটা সময় ছিল যাযাবর। তাদের সমাজ এই প্রাচীন রীতি এখনও বর্জন করতে পারেনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু জনজাতির ভেতরেও মেয়েদের সতীত্ব প্রমাণের রীতি প্রচলিত রয়েছে। সেই রীতি বড়ই লজ্জাজনক। প্রতি বছর জুলু প্রজাতির অবিবাহিত মেয়েদের ওই কুমারীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়। প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন জেলা থেকে সতীত্বের পরীক্ষা করাতে হয়। পরে তাদের রাজার কাছ থেকে সতীত্বের চূড়ান্ত ‘সার্টিফিকেট’ নিতে হয়। জুলু কিশোরীরা, যাদের বয়স ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে, মূলত তাদেরই এই পরীক্ষা দিয়ে সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয়।

সতীত্ব

জুলু কিশোরীরা রাজপ্রাসাদের পথে।

যে দিন তারা রাজার প্যালেসে যায়, সে দিন জুলু কুমারীরা আনন্দ-উৎসব করে। তাদের ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও পোশাক থাকে না। উন্মুক্ত বক্ষ। নীচের অংশে ঐতিহ্যশালী পোশাক। গলার কাছে নানা ধরনের অলঙ্কার। রাজার বাড়ির সামনে ওই দিন তারা গান গায়, নাচ করে। সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে। তাকে ‘রীড’ বলে। এই রীতি আসলে বয়ঃসন্ধির। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তারা বিশুদ্ধ কুমারী রূপে গণ্য হয় সমাজে। ১৯৮৪-তে রাজা জয়েলিথিন এই প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু মেয়েদের সম্মানের জন্যই নাকি তা বন্ধ করা যায়নি।

যে দিন তারা রাজার প্যালেসে যায়, সে দিন জুলু কুমারীরা আনন্দ-উৎসব করে। তাদের ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও পোশাক থাকে না। উন্মুক্ত বক্ষ।

অনেকেই এই রীতির বিরুদ্ধে। তার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, উন্মুক্ত বুকে নাচ-গান করা ওই সব কিশোরীদের ছবি পর্ন-ছবির ব্যবসায়ীরা অসৎ উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারে। আবার হাজার হাজার কিশোরী যখন রাজার বাড়িতে সতীত্বের পরীক্ষার দিতে জমায়েত হয়, তখন পদপৃষ্টের সম্ভাবনা তাকে। গত বছর যেমন কয়েক জন পদপৃষ্ট হয়ে মারাও গিয়েছেন। কিন্তু, প্রথা বন্ধ হয়নি। রাজা সতর্ক করেছেন, কেউ যেন ওই অনুষ্ঠানের ছবি না তোলে। কিন্তু, এই দুনিয়ায় কি তা সম্ভব!

সতীত্ব

সতীত্বের প্রমাণ দিতে রাজপ্রাসাদের পথে জুলু কিশোরীরা।

আবার এই দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য একটা অংশে বয়ঃসন্ধির সময়ে মেয়েদের জন্য থাকে কঠিন রীতি। যেমন মোজাম্বিক দেশের কথাই ধরা যাক। সেখানে ম্যাকুয়াদের প্রচলিত রীতি ভীষণই কষ্টকর। তাদের রীতি অনুযায়ী প্রথম ঋতুস্রাবের পর মেয়েদের আলাদা রাখা হয় কিছু দিন। এখানেই শেষ নয়, নারী হিসাবে পূর্ণতা প্রাপ্তির চিহ্ন হিসেবে তাদের ক্লিটোরিসের একটা অংশ কেটেও দেওয়া হয়। আর এই প্রথা মেয়েরা গর্বের সঙ্গে পালন করে!

এই প্রথা কোথাও রীতি হিসাবে, কোথাও বা এইচআইভি বা এইডসের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার অজুহাতে। কোথাও শুধুমাত্র পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য।

তবে, প্রতিবাদও আছে। গত বছরের জুলাইয়ে তাজিকিস্তানের ওই ঘটনাও চমকে দিয়েছিল সকলকে। সে দেশে সতীত্ব প্রমাণের বিরোধিতা করে ১৮ বছরের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তার ২৪ বছর বয়সী স্বামী তাকে একাধিক বার ওই পরীক্ষার জন্য বাধ্য করেছিলেন। মেয়েটি রাজি না হওয়ায় তার স্বামী দ্বিতীয় বার বিয়ে করবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে মেয়েটির ওই পরিণতি বেছে নেয়।

সতীত্ব

প্রতিবাদের ভাষা…

আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি তুরস্ক, মিশর-সহ একাধিক দেশে এমন সতীত্ব প্রমাণের রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই প্রথা কোথাও রীতি হিসাবে, কোথাও বা এইচআইভি বা এইডসের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার অজুহাতে। কোথাও শুধুমাত্র পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য। যে কারণেই হোক না কেন, সব দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেয়েরা। তারা শুধু শারীরিক ভাবেই বিপর্যস্ত হচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানসিক ভাবেও। আমাদের দেশে তো বিষয়টি আদালত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।

হাইমেনই কি সম্পর্কের একমাত্র হাইফেন!

যত ক্ষণ একটা রীতি মানুষের কোনও ক্ষতি করে না, তত ক্ষণ সেটা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সম্মান পেতে পারে। কিন্তু যখন তা মানুষের ক্ষতি করে, তখন তা বর্জন করাই ঠিক।