ডায়াবেটিস আসলে নিঃশব্দ খুনি, কিন্তু পরিশীলিত জীবনযাপনই পারে তাকে ঠেকাতে

ডায়াবেটিস আসলে নিঃশব্দ খুনিডায়াবেটিস আসলে নিঃশব্দ খুনি: সচেতনতা শিবিরে...

রূপসা সেন


ডায়াবেটিস আসলে নিঃশব্দ খুনি, আর সেই খুনিকে ঠেকাতেই প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করছে ‘ডে’। ডে মানে ‘ডায়াবেটিস অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড ইউ’।

সেই কাজেরই অংশ হিসাবে বুধবার কলকাতার বাইপাস সংলগ্ন ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন ক্লাবে এক সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করে ‘ডে’। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় নিখার গর্গ, অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী, কমিশনের সদস্য সুদেষ্ণা রায়, ‘ডে’-র কর্ণধার দেবাশিস বসু প্রমুখ। হাজির ছিলেন টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বহু শিশু এবং তাদের পরিবারের লোকজন। এ দিনের অনুষ্ঠানে ‘ডে’-র তরফে ওই শিশুদের ইনসুলিন পাম্প দেওয়া হয়। এক একটি পাম্পের দাম প্রায় ২ লাখ টাকা।

শিবিরে প্রধান অতিথি নিখার গর্গ নিজেই টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এক জন। সেই অবস্থাতেই তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেন। তাঁর কেরিয়ারে কোনও বাধা তৈরি করতে পারেনি নিঃশব্দ খুনি। কারণটাও জানিয়েছেন নিখার, জীবনে নিয়মানুবর্তিতা। সেই মন্ত্রেই ঘায়েল করেছেন ডায়াবেটিসের মতো খুনিকে। তাঁর কথায়, ‘‘ডায়াবেটিস কোনও ডিসঅর্ডার নয়, ডিজিজ নয়, ডিসএবিলিটি নয়, আমি কোনও পেশেন্ট নই। শুধু সচেতনতা এবং সুশৃঙ্খল জীবনচর্চা দিয়েই ডায়াবেটিসকে ঠেকানো সম্ভব।’’

পরমব্রত এবং নিখার

পরমব্রত এবং নিখার…

নিখার বলছিলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে তিনি সময় কাটান না। কারণ, তাঁদের আলোচনার বিষয়ই সব সময়, ‘সুগার লেভেল বাড়ল?’, ‘আমি আজ ব্লাড টেস্ট করালাম, ২২০ এসেছে’— ইত্যাদি। তার থেকে অন্যদের সঙ্গে সময় কাটানো ভাল বলেই মনে করেন নিখার। তাতে নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হয় না। শিবিরে হাজির অন্যদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ, ‘‘জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবনা তৈরি করুন। নিজের নেতিবাচক দিক নিজের কাছে রেখে দিয়ে শুধু ইতিবাচক দিকটাই তুলে ধরুন অন্যদের সামনে।’’

নিখার নিজে একটি ইনসুলিন পাম্প ব্যবহার করেন। ওই যন্ত্র থেকে প্রয়োজন মতো ইনসুলিন শরীরে যাতায়াত করে। পেটের ঠিক কাছেই একটি চ্যানেলের মতো পাম্পটি লাগানো থাকে। এ দিন শিবিরে হাজির ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একাধিক শিশুকে তেমনই অনেকগুলি পাম্প দেওয়া হয়েছে ‘ডে’-র তরফে।

অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ডায়াবেটিসে দীর্ঘ দিন ভোগার পর তাঁর মা সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। শিবিরে হাজির ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সকলকে দেখে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে লড়াই আপনারা করছেন, সেখানে নিজের কেরিয়ার নিয়ে লড়াইটাকে কত তুচ্ছ মনে হয়। আমার মায়ের ডায়াবেটিস ছিল। সেই সময়েই ‘ডে’র সঙ্গে পরিচয়। এক দল মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করছেন, আর এক দল মানুষ তাঁদের সাহায্য করবেন বলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভীষণ ভাল লাগে। আমিও পাশে থাকতে চাই।’’ এ দিন ক্লাবে পরমব্রতকে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখা যায় নিখারের সঙ্গে।

কী বললেন নিখার গর্গ…

সাংবাদিকতা, চিত্র পরিচালনার এবং অভিনয়ের পাশাপাশি সুদেষ্ণা রায় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের সঙ্গেও যুক্ত। তিনি নিজেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু, একটা সময় পর্যন্ত সুদেষ্ণা জানতেন না তাঁর ডায়াবেটিস রয়েছে। মধ্য চল্লিশে পৌঁছে চোখের ছানি অপারেশন করানোর আগে রক্তে শর্করার পরিমাণ অর্থাৎ ব্লাড সুগার টেস্ট করাতে গিয়ে জানতে পারেন, মাত্রাটা অনেকটা বেড়েছে। তার পর নিয়ন্ত্রিত জীবনচর্চা এবং ‘ডে’-র পরামর্শেই তিনি নিঃশব্দ খুনিকে ঠেকিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ছোটবেলায় আমি পোলিওতে আক্রান্ত ছিলাম। কিন্তু, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে জয় করে বিপুল কাজকর্ম করেছি। কিন্তু, আমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সেটা কখনওই বুঝতে পারিনি। কাজে কোনও অসুবিধা হত না। চোখে ছানি না পড়লে জানতেই পারতাম না। অথচ ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতাম। আসলে আমরা এই বিষয়ে খুব একটা সচেতন নই। সচেতন থাকলে অনেক আগেই ধরা পড়ত। কাজেই ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতার প্রয়োজন আছে।’’

অনন্যা চক্রবর্তীও এ দিনের শিবিরে ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতার কথাই বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘শিক্ষা দফতরের সঙ্গে আমার নিয়মিত বৈঠক হয়। ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনার প্রয়োজন রয়েছে বলেই, আমি ওদের কাছে একটা অনুরোধ করব। স্কুলের পাঠ্যবইতে যাতে অন্তত এক পাতা ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনার কথা লেখা থাকে। তা হলেই আমাদের অনেকটা কাজ হবে।’’

গরমকালের রোগ এবং তার হোমিওপ্যাথিক প্রতিকার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, সচেতনতা না বাড়ালে ডায়াবেটিস মহামারীর আকার নেবে। চসেচনতা বাড়ালে এই নিঃশব্দ খুনিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ‘ডে’ সব সময় সেই সচেতনতার কাজই করে এসেছে। স্বেচ্ছাসেবী ওই সংস্থার কর্ণধার দেবাশিস বসু নিজেও ডায়াবেটিস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। যে ভাবে তাঁর সংস্থার ডাকে সাড়া দিয়ে সকলে সচেতনতা শিবিরে এসেছেন তাতে স্বভাবতই খুশি তিনি। যাঁদের দিকে ‘ডে’ পাশে থাকার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে— সেই অঙ্কিতা বা আসমারা এ দিনের শিবিরে এসেছিল। তাদের দেখিয়ে দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘ওরা সবাই আমার সন্তান। বুক আগলে সবাইকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করেছি। সে অঙ্কিতাই হোক আসমা। অঙ্কিতা যখন আমার কাছে এসেছিল ও তখন প্রায় কোমায়। আমার ওষুধে ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার পর টানা তিন দিন ওকে কোলে নিয়ে চিকিৎসা করেছি। আজ ও আইটি সেক্টরে চাকরি করে। ওরা আর ১০টা স্বাভাবিক মানুষের মতোই। ওদের আলাদা করে যেন না দেখে কেউ। এটাই বার্তা দিয়ে চাই সব সময়।’’

এ দিনের শিবির একটা কথাই বুঝিয়ে দিল, ডায়াবেটিস নিঃশব্দ খুনি হতে পারে, কিন্তু পরিশীলিত জীবনযাপন তাঁকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সুস্থ বেঁচে থাকাকে নিশ্চিত করে। আর সে জন্যই চাই সচেতনতা।