ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কৃষ্ণ ছত্রাক চোখ রাঙাচ্ছে ভারতে— কিছু জরুরি তথ্য

ক্রমশ বাড়ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কৃষ্ণ ছত্রাকও মহামারির আকার ধারণ করেছে কোভিড অতিমারির সঙ্গে সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এই রোগ কী, কেমন করে হয়, এবং কতখানি মারাত্মক, সে সম্পর্কে আগে থেকে জানা থাকলে হয়তো বা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব প্রতিরোধ করার জন্যে। নিউ ইয়র্ক থেকে লিখলেন ডঃ পার্থ বন্দোপাধ্যায়


আমি দীর্ঘদিন ধরে ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করেছি। গবেষণা এবং অধ্যাপনা। প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যেসব রোগীর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনও রোগের কারণে অথবা কোনও বিশেষ ওষুধ খাওয়ার ফলে খুব কমে যায়, তাদেরকেই এইজাতীয় ছত্রাক আক্রমণ করে বেশি। শুধু কোভিড নয়, এইডস রোগীদের ক্ষেত্রেও এই জাতীয় ছত্রাকের আক্রমণ দেখা যায়। অথবা, যাদের হার্ট, কিডনি জাতীয় কোনও অর্গ্যান সার্জারি বা প্রতিস্থাপন হয়েছে। কারণ সেই একটাই, নানাধরণের ইমিউনিটি-কমিয়ে দেওয়া ওষুধ খাওয়ার ফলে সেকেণ্ডারি ইনফেকশন বা গৌণ সংক্রমণ হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। তারপর সেই “গৌণ সংক্রমণ” মারাত্মক ক্ষতি বা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের দেশের বহু হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে পরিচ্ছন্নতার অভাব থাকার কারণে, এবং উষ্ণমণ্ডলীয় জলীয় বাষ্পবহুল দেশ হওয়ার কারণে ছত্রাক অতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। যেসব জায়গায় জল, জলীয় বাষ্প এবং চারদিক ঘেরা বদ্ধ পরিবেশ থাকে, সেখানেই ছত্রাক বাসা বাঁধে। যেমন, পাঁউরুটির টুকরো বা কাটা ফল রেফ্রিজারেটরের কোণে আলগা পড়ে থাকলে তাতে দু একদিনের মধ্যেই সবুজ ছত্রাকে ভরে যায়, এখানেও ঠিক তাই। কিন্তু ছত্রাকের নাম আলাদা।

কোভিড রোগীদের আক্রমণ করে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কৃষ্ণ ছত্রাক— যার বৈজ্ঞানিক নাম মিউকোর (Mucor)। এটি এক বিশেষ শ্রেণীর ছত্রাক, যে শ্রেণীর নাম জাইগরমাইসিটিস। ওই পাঁউরুটির ওপর জন্মানো সবুজ ছত্রাকের নাম পেনিসিলিয়াম (Penicillium) যার থেকে বহুকাল আগে পেনিসিলিন আবিষ্কার করা হয়েছিল। যা এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। পেনিসিলিয়াম শ্রেণীর আরও একটি ক্ষতিকর ছত্রাকের নাম এ্যাসপারজিলাস (Aspergillus)। অন্য কিছু রোগের ক্ষেত্রে বা অন্য কোনও ভৌগোলিক পরিসরে এ এক মারাত্মক সংক্রমণ।

আজকাল অবশ্য শ্রেণীবিন্যাস নতুনভাবে করা হয়েছে। আমি মোটামুটিভাবে একটা পুরোনো শ্রেণীবিন্যাস করে দিলাম সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্যে। কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে মিউকোর যে সংক্রমণ সৃষ্টি করে, তার নাম মিউকোর-মাইকোসিস। ঠিক সময়ে প্রতিরোধ না করলে এই সংক্রমণ শরীরের নরম টিস্যু অর্থাৎ কোষকলাতে ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিশেষ করে চোখ, নাক ও মুখের মারাত্মক ক্ষতি করে। অনেক কোভিড রোগী আমাদের দেশে এখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। মস্তিষ্ক, ফুসফুস এবং অন্ত্রেও সংক্রমণ হয়।

আমাদের দেশের জলীয় আবহাওয়াতে মিউকোর তার অতি সূক্ষ্ম এবং প্রায় অদৃশ্য ফিতের মতো দেহ রোগাক্রান্ত দুর্বল মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়, এবং তার প্রজনন কোষ যার নাম স্পোর অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। প্রতিটি স্পোর ফলের বীজের মতোই বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া তাদের খালি চোখে দেখা যায় না। ঠিক সময়ে ছত্রাক-দমন করার ওষুধ না পড়লে এর দ্রুত বৃদ্ধি বন্ধ করা অসম্ভব। তাই, আমাদের দেশের হাসপাতালে, হেলথ সেন্টার ও নার্সিং হোমের ডাক্তার ও নার্সদের প্রতিনিয়ত লক্ষ্য রাখতে হবে, রোগীর শরীরে মিউকোর-মাইকোসিস হবার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা।

যে কোনও রোগীর ক্ষেত্রেই বিছানা, চাদর, বালিশ, মাস্ক, ভেন্টিলেটর, খাবার দেওয়ার বাসনপত্র, বাথরুমের দেওয়াল, পাইপ, এয়ার কন্ডিশন যন্ত্র, পাখা, ইলেক্ট্রিক তার ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস শুকনো এবং পরিষ্কার থাকলে ছত্রাক বংশবৃদ্ধি করতে পারে না ভাল করে। এই শুষ্কতা এবং পরিচ্ছন্নতাই কৃষ্ণ ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করার একমাত্র উপায়। এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।

মিউকোর-মাইকোসিস হলে তার ওষুধ আছে। কিন্তু আমি যেহেতু ডাক্তার নই, ওষুধ সম্পর্কে আমি কোনও পরামর্শ দেব না। শুধু মনে রাখবেন, যা হোক একটা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলেই কৃষ্ণ ছত্রাকের সংক্রমণ বন্ধ করা যাবে না। আমাদের দেশে মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। যা ভবিষ্যতে নতুন এক সঙ্কট ডেকে নিয়ে আসছে। অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না, কারণ কোভিড যেমন বিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, তেমনই অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া ও বীজাণুও অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্টেন্ট হয়ে গিয়েছে, যার কোনও ওষুধ আমাদের জানা নেই।

ব্ল্যাক ফাংগাস বা কৃষ্ণ ছত্রাক সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন।

(লেখা ও লেখার বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে লেখকের ‌নিজের)

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)