স্বপ্না বর্মন, জীবনের সঙ্গে লড়াই করে উঠে আসা এক স্বপ্নের নাম

স্বপ্না বর্মন

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: স্বপ্না বর্মন এশিয়ান গেমসে সোনা জিতে ট্র্যাকের উপরেই শুয়ে পড়েছিলেন। পরে বলেছিলেন, ‘‘আসলে নিজের অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।’’ কেউ ভাবেইনি, তিনি জাকার্তা এশিয়ান গেমসে এমন দাপট দেখাবেন! দাঁতের ব্যথায় কাবু মেয়েটিকে নিয়ে চিন্তায় রাতের ঘুম উধাও হয়েছিল জলপাইগুড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িরও। কিন্তু কী আশ্চর্য! ব্যথা দাঁতের গালে নানা রঙের আঁকিবুকি করেই ট্র্যাকে নেমেছিল মেয়ে। গাল ফুলে ঢোল তখন। ট্র্যাক সবটা ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর আজ আরও এক বার সব কেমন অন্য রকম লাগছে। স্বপ্নের রাজ্যে বিরাজ করছেন স্বপ্না বর্মণ। কয়েকদিন আগেই জানা গিয়েছে অর্জুন প্রাপকদের নাম। তাতে রয়েছেন তিনিও।

জীবনে জুতোবিভ্রাট


চতুর্থ শ্রেণিতে যখন পড়ত মেয়ে, তখন থেকেই দৌড় শুরু। তার পর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। লড়াই, লড়াই, লড়াই করে যেতে হয়েছে। সব থেকে বেশি সমস্যায় ফেলেছে জুতো। স্বপ্নার দু’পায়েই ৬টি করে আঙুল থাকায় স্বাভাবিক মাপের কোনও জুতোই ওঁর পায়ে হয় না। স্থানীয় এক সংস্থা একটা সময় বানাত। পরে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহা বিপদে পড়েন স্বপ্না। সেই পুরনো জুতো পরেই নামতে হয় এশিয়ান গেমসে। পরে অবশ্য বিদেশে গিয়ে জুতোবিভ্রাট মিটেছিল। ৭টি ইভেন্টের জন্য বিশেষ সাত জোড়া জুতো পেয়েছেন তিনি।

জুতো সমস্যা আপাতত মিটেছে। এই নিয়ে তো কাটিয়েই দিলাম। এশিয়ান গেমসের আগে চিন্তায় ছিলাম। জুতোগুলো অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছিল। গ্রিপ নষ্ট হয়ে যায় তাতে। তাই পরেই নামতে বাধ্য হয়েছিলাম। কী করব!

কোচ সুভাষ সরকার


খুব রাগ! রেগে গেলে মাথার ঠিক থাকে না মোটেই। সে রকমই একটা সময়ে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশে। জলপাইগুড়ির গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন স্বপ্না। তার পর এসে পড়া কোচ সুভাষ সরকারের কাছে। কিন্তু, তার পরেও সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। দু’বছর নানা রকমের সমস্যা, চোটে জেরবার হয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। অনেকেই বলছিলেন, স্বপ্না ফিনিশ! রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ব্যস, আবার পালালেন স্বপ্না। এ বার সাই ছেড়ে জলপাইগুড়ির গ্রামে। আর ট্র্যাকে নামবেন না ভেবেই নিয়েছিলেন। চাকরি জোগাড় করে কোনও রকমে দিন গুজরান করার ছকও কষে ফেলেছিলেন। কিন্তু ওই যে, নিজের ছাত্রীকে চিনেছিলেন সুভাষ। ঠিক ধরে-বেঁধে ফিরিয়ে এনেছিলেন স্বপ্নাকে।

কত বার পালিয়েছি। কখনও বাড়ি থেকে তো, কখনও সাই থেকে। আসলে দৌড়টাই তো জীবন, তাই দৌড়েই বেড়িয়েছি। ভাগ্যিস স্যর ছিলেন!

জলপাইগুড়ি জেলার পাতকাটা গ্রাম


কেউ কোনও দিন এখান থেকে এ স্বপ্ন দেখেনি। নিতান্তই একটা গরিব গ্রাম। কোনও রকমে টিনের ছাদের নীচে মাটির ঘরে দিন কাটানো। গ্রামের মেয়েরা যেমন সব খেলে, স্বপ্নাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফুটবল, কবাডি থেকে কখন যেন ট্র্যাকে নেমে পড়া। স্কুল, জেলা, রাজ্য, দেশ টপকে ধাপে ধাপে বিশ্বের দরবারে জাতীয় পতাকা ওড়ানো। গলাটা কোথাও বুজে আসে। এতটাও তো ভাবেনি ভ্যানচালক বাবার মেয়ে! স্বপ্ন দেখতেই ভয় লাগত। খাওয়াও জুটত না অর্ধেক দিন পেটপুরে। তাতে আবার সোনার স্বপ্ন।

শুধু জল খেয়ে কত দিন প্র্যাকটিস করেছি! বাবাকে বলতে পারতাম না কোনও কিছুর কথা।

২০১২তে সাইয়ে এসেছিলেন স্বপ্না। আগে শুধুই হাই জাম্প করতেন। ২০১৩তে হেপ্টাথেলনে নিয়ে আসেন কোচ সুভাষ সরকার। ২০১৪তেই এশিয়ান গেমসে নেমে পড়েছিলেন।

সেটাই ছিল প্রথম সিনিয়র কোনও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। পদক না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। শেষ এশিয়ান গেমস সেই ক্ষত মুছে দিয়েছে।

চোট, শারীরিক সমস্যাকে ছাপিয়ে যাওয়া


২০১৮ জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সবাই জানে কী অসহ্য দাঁতে ব্যথা নিয়ে পদক জিতেছেন স্বপ্না। দাঁতের ব্যথা কমাতে গালে অদ্ভুত এক ওষুধ লাগিয়ে ট্র্যাকে নেমেছেন। সারা রাত ব্যথায় ছটফট করেছেন! ঘুমোতে পারেননি। নিজেই ভাবতে পারেননি যে, পারবেন। কিন্তু, এ সবের থেকে অনেক বড় বড় সমস্যা কাটিয়ে এসেছেন যিনি, তাঁকে দাঁতের ব্যথা কী করে দমিয়ে রাখবে?

সেই পিঠের ব্যথার কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে উঠি। ২০১৪তে পিঠের ব্যথা যে ভাবে কাবু করে দিয়েছিল, ভাবতেই পারিনি আর কখনও ফিরতে পারব। সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ট্র্যাকে না নেমেও তো প্রতি দিন একটু একটু করে মরছিলাম। স্যরই ফিরিয়ে আনেন আমাকে।

সিনিয়র ন্যাশনাল জিতে ১০ লাখ টাকা


এত টাকা এর আগে একসঙ্গে দেখেননি কখনও। ২০১৭তে ওড়িশায় সিনিয়র ন্যাশনাল জেতার পর ওড়িশা সরকারই স্বপ্নাকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দিয়েছিল। এই টাকা কত জমে থাকা কাজ করতে সাহায্য করেছে স্বপ্নাকে।

এত টাকা একসঙ্গে কখনও দেখিনি। আমার কাছে বিরাট ব্যাপার ছিল ওটা। খেলার কিটস কিনেছিলাম কিছু। কিন্তু, বেশির ভাগ টাকাটাই গ্রামে বাড়ি করতে খরচ করেছিলাম। টিন সরিয়ে পাকা দেওয়াল করিয়েছিলাম। যখনই কিছু টাকা পেয়েছি, ভেবেছি, বাড়ির সবাইকে একটু ভাল খেতে দেব। ভাল পরতে দেব। এখন অনেক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। পরিবারের মানুষগুলোকে ভাল রাখতে চাই।

স্বপ্না বর্মণ। আর কিছু দিন পর তাঁর নামের আগে বসবে অর্জুন স্বপ্না বর্মন। দেশের নাম উজ্জ্বল করা বাংলার এই মেয়ের চোখে এখন শুধুই অলিম্পিকের স্বপ্ন। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের অপেক্ষায় সেদিন রাত জাগবে গোটা দেশ। চিৎকার করে বলবে ‘রান স্বপ্না রান।’

(আরও ইন্টারভিউ পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)