মুক্তিস কিচেন: আমেরিকাকে ভারতীয় রান্না শেখাচ্ছেন এক বাঙালি, কেমন সেই অভিজ্ঞতা?

মুক্তিস কিচেন

মুক্তিস কিচেন ও তার উঠে আসা একটা কাহিনী। ৩২ বছর আগে দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু ছাড়তে পারেননি দেশের ফ্লেভার। আর এই ভারতের সব থেকে বড় আকর্ষণ তো তার খাওয়া। তাই মা-দিদিমার কাছ থেকে ছোটবেলায় চেখে দেখা সেই খাওয়ার স্বাদকে আমেরিকায় বসে ক্রমশ নিজের রূপ দিয়েছেন মুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়। আর আজ তিনি ব্রুকলিনের ‘কুকিং টিচার’। আমেরিকানদের শেখাচ্ছেন ভারতীয় রান্না। আর সেই রান্নাই চেটেপুটে খাচ্ছেন আমেরিকাবাসীরা। সেই তালিকায় কখনও ডাল, রুটি, পরোটা, ফ্রায়েড রাইস, শাক পনির, বেগুন ভর্তা আবার কখনও চিকেন ভর্তা, চিংড়ি মালাইও থাকছে সেই তালিকায়। আর সেই ভারতীয় রান্নার প্রেমে পড়ে গিয়েছে আমেরিকার একটা অংশ।  মুক্তিস কিচেনের মুক্তি আমেরিকায় বসে মেলে ধরলেন তাঁর সেই অভিনব কাজের কথা জাস্ট দুনিয়ার সামনে।

প্র: কত বছর দেশের বাইরে?

মুক্তি: আমি এসেছিলাম ১৯৮৬ সালে। ৩২ বছর হয়ে গেল।

প্র: ঠিক কবে মনে হল এমন কিছু করা যায়?

মুক্তি: ২০১০ থেকে আমি নিজের কিছু একটা করতে চাইছিলাম। সারা জীবন অন্যের জন্য কাজ করতে আর মন চাইছিল না।

এই গরমে আপনার ডায়েটে কী রাখবেন?

প্র: একদম বাঙাল রান্না নাকি ঘটিদের রান্নাও আপনার রান্না ঘরে তৈরি হয়?

মুক্তি: আমার ক্লাসে ঘটি বা বাঙাল বলে কোনও রান্না শেখাই না। প্রধানত ভারতীয় রান্নার মূল জিনিস গুলোর ওপর কাজ করি আর ওদেরকে সহজ করে শেখাতে চাই। যেহেতু বিভিন্ন রকমের মশলা ওদের কাছে একদম নতুন।

প্র: কী ভাবে শুরু হল পথ চলা?

মুক্তি: আমি যেহেতু অনেক বছর বিভিন্ন সাইন্স ল্যাবে কাজ করেছি লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছে যা আমার খুব পছন্দের। আর রান্না আমার খুব প্রিয়।  তাই আমি ভাবতে শুরু করি লোকে আমার কোন কোন জিনিস খুব পছন্দ করেন। দেখলাম আমার রান্না তার মধ্যে অন্যতম।

মুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়

প্র: তার পর?

মুক্তি: আমার শেখাতে খুব ভাল লাগে। আর ভারতীয় খাওয়া খুব জনপ্রিয় আর স্বাস্থকর। তবে অবশ্যই সেটা নিজেকে করতে হবে। তাই আমাদের এই পূর্বের অভিজ্ঞতা পশ্চিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমার রান্নার মাধ্যমে।

প্র: প্রথম কতজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল?

মুক্তি: প্রথমে আমি ‘meetup’ বলে একটা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমার রান্নার ক্লাস শুরু করি। সেখানেই ছিল ১০০ জন মতো ছাত্রছাত্রী।

প্র: এখন কতজন রয়েছেন?

মুক্তি: এর পর আমার নিজের ওয়েবসাইট মুক্তিস কিচেন ডট কম (www.muktiskitchen.com) তৈরী করি। সেখানে আমার ২০০০ এর উপর ছাত্রছাত্রী ছিল।

দেখুন ভিডিও

প্র: যাঁরা শিখতে আসছেন তাঁরা সকলেই কি আমেরিকান, নাকি অন্য দেশেরও আছে?

মুক্তি: যারা আমার ক্লাসে আসে তার বেশির ভাগই আমেরিকান।  কিছু অন্য দেশেরও রয়েছে। তবে সবাই ভাল ইংরেজি বলতে পারে।  আমার ক্লাসে একজন এমন রয়েছে যে শুধু ফিনল্যাণ্ড থেকে আমেরিকায় এসেছিল আমার কাছ থেকে ধোসা বানানো শিখবে বলে।

প্র: ভারতীয়রা শেখার আগ্রহ দেখাচ্ছেন?

মুক্তি: সেকেন্ড জেনারেশন ভারতীয়রা যারা তাদের মা, বাবার কাছে শেখেনি, তারা এখন নিজেরা করতে চায় আর আমার কাছে আসে।

প্র: আপনি কার কাছ থেকে শিখেছেন রান্না?

মুক্তি: আমার  মা, ঠাকুমা, পিসি, সবাই খুব ভালো রান্না করতে পারত। আমি ওদের রান্নার টেস্টার ছিলাম সবসময়। তাই ওই রান্নাগুলোর টেস্ট আমার মাথায় রয়ে গিয়েছে। আর সেগুলোই আমি নিজের মতো করে রূপ দিই।

ভারতীয় রান্না মুক্তিস কিচেনে।

প্র: ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সব থেকে কী ধরনের পদ শেখার আগ্রহ বেশি?

মুক্তি: এখন নিরামিষ রান্না খুব জনপ্রিয়। সবাই স্বাস্থ্য সচেতন। তাই ভারতীয় নিরামিষ রান্না যেমন, ডাল, রুটি, পরোটা, ফ্রায়েড রাইস, শাক পনির, বেগুন ভর্তার খুব চাহিদা। অথবা ভিগান রান্না ওদের খুব পছন্দ। এ ছাড়া, চিকেন টিক্কা মশালা, চিংড়ি মালাই, ল্যাম ভিন্ডালু, ল্যাম কোর্মা, এ সব তো আছেই।

এখানে যারা ভারতের এবং বাংলার রান্না বা অন্য আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তারা স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস, যোগব্যায়াম এ সব করছে। নিয়মিত এবং পরিমিত জীবনযাত্রায় মন দিচ্ছে। বিভিন্ন নামী সংস্থার খাওয়ার, পানীয় বর্জন করছেন আমেরিকানরা অর্গানিক ফুড খাচ্ছে।

প্র: ভারতীয় রান্নাকে বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিতে কোনও প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়তে হয়েছিল?

মুক্তি: একদমই না। সবাই ভারতীয় রান্না, সঙ্গীত, পোশাক খুব পছন্দ করে।  যদিও সবকিছুই উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত আমেরিকানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ যদি আমি নিউ ইয়র্ক শহরের মতো জায়গায় না থাকতাম, তা হলে এত জনপ্রিয়তা পেতাম কিনা সন্দেহ।

ভারতীয় খাওয়ার দারুণ উপভোগ করেন আমেরিকানরা।

প্র: এর পর আর কোনও পরিকল্পনা ভারতীয় রান্না নিয়ে?

মুক্তি: আমি একটা কুকবুক লিখছি। আর এখানকার স্টুডেন্টদের নিয়ে ভারত সফরের পরিকল্পনা রয়েছে।

প্র: রেস্টুরেন্ট খোলা বা বিদেশি ফুড ফেস্টিভ্যালে ভারতীয় খাবার তুলে ধরার কোনও পরিকল্পনা?

মুক্তি: আমি রেস্টুরেন্ট খুলতে চাই না। তাতে নিজের কোনও ফ্রি টাইম বা ছুটি থাকে না। যেটা আমার পছন্দ না। কিন্তু আমি এখানকার বেশ কিছু ফুড ফেস্টিভ্যালে আমার ফুড এর ষ্টল দিয়েছি।

প্র: আপনার কাছের মানুষরা আপনার হাতের সব থেকে কোন পদ খেতে ভালবাসেন?

মুক্তি: এটা তো বলা মুশিকল। তবে সবাই আমার তৈরি নিরামিষ, মাছ, মিষ্টি পছন্দ করে।

চায়ের সঙ্গে বেগুনিও দারুণ চলে।

প্র:  আপনার রান্না ঘরের সাফল্যের পিছনে কাকে কাকে কৃতিত্ব দেবেন?

মুক্তি: আমার রান্নাঘর এর জন্য অবশ্যই আমার স্বামী পার্থ আর আমার মেয়ে নন্দিনী কে কৃতিত্ব দেব। ওরা সবসময় আমার পাশে থেকেছে আর আমাকে নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে চলেছে।

প্র: এই রান্নাঘর নিয়ে কলকাতায় আসার ইচ্ছে আছে কখনও?

মুক্তি: যদি কলকাতায় রান্না শেখাই তা হলে ওদের আমি বিদেশী রান্না শেখাব যেটা আমি এই দেশ থেকে শিখেছি। তা ছাড়া, আগে যেটা বললাম, হেলথি লাইফস্টাইল শেখাব।