১৫ অগস্ট কো কেয়া হ্যায় পাপ্পু? হলুদ দাঁত বার করে হেসে সে বলে…

১৫ অগস্ট‘‘উৎসব হয় উৎসব! সারা দিন মাইকে গান বাজনা কত কী...’’

১৫ অগস্ট, ২০২০— শিক্ষিত-অশিক্ষিত-ধনী-দরিদ্রে মেলানো মেশানো ১৩৫ কোটি মানুষের দেশ ভারতে আজ ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু কেমন আছি আমরা? কী ভাবছে মেয়েরা? কোন পথেই বা ভাবনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেশের তরুণ প্রজন্ম? লিখছেন বলাকা দত্ত


কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে জুতো পালিশ করে পাপ্পু। বয়স সতেরো।

পাপ্পু, ১৫ অগস্ট কো কেয়া হ্যায়?

হলুদ দাঁত বার করে হাসে। উৎসব হয় উৎসব! সারা দিন মাইকে গান বাজনা কত কী…।

হরিশকুমার যাদব। বয়স আটচল্লিশ। বাড়ি বিহারের মধুবনী জেলার বেলহা গ্রামে। রাজমিস্ত্রি। কলকাতা-দিল্লী-মুম্বই সব বড় বড় শহরে বেশ কয়েক বার গিয়েছে কাজের সন্ধানে।

হরিশ, ১৫ অগস্ট কেয়া হ্যায়?

হরিশ মিটিমিটি হাসে।

হরিশ, আপকো আজাদি কা মতলব পাতা হ্যায়?

সাব, হাম আনপড় আদমি হ্যায়।

রাজস্থানের আলওয়ারের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সচিন।

সচিন, কেয়া হ্যায় ১৫ অগস্ট?

স্কুল ছুট্টি হ্যায়।

এ হেন শিক্ষিত-অশিক্ষিত-ধনী-দরিদ্রে মেলানো মেশানো ১৩৫ কোটি মানুষের দেশ ভারতে আজ ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস।


দেশের আরও খবরের জন্য এখানে ক্লিক করুন

আক্ষরিক অর্থে ভারতে স্বাধীনতা দিবস বা ১৫ অগস্ট মানে সরকারি ছুটি, আলস্যে ভরা দিন, সকাল হলেই টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা, দুপুরে জমিয়ে একটা লাঞ্চ। এটাই হল বিশ্বের কাছে ধোপদুরস্ত ডিজিটাল ভারতের মুখ। কিন্তু এই গণ্ডির বাইরে, পড়ে আছে এক আদিগন্ত বিস্তৃত ভারত ও তার স্বাধীনতার পরিহাস।

গত কয়েক বছর ধরেই এই দিনটায় ফেসবুক থেকে টুইটার, জাতীয় পতাকার রঙে রাঙা হয়ে ওঠে প্রোফাইলের মুখ। গোটা দেশে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ উদ্‌যাপনের সুনামি আছড়ে পড়ে। অথচ মজার কথা হল, এই সোশাল মিডিয়াতেই কারও কোনও মন্তব্য রাষ্ট্র ও শাসকদলের অনুকূলে না গেলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অনায়াসে দেগে দেওয়া হয়। কিছু দিন আগে অনুরাগ কাশ্যপ শেষ টুইট করেছিলেন, ‘নতুন ভারতে যুক্তির কোনও জায়গা নেই। আমি চললাম।’

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ স্বাধীন ভারতের বর্ণনা করে লিখেছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য…।’ তখন ক্ষমতায় ছিলেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। ২০২০-তে ক্ষমতায় আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের নির্বাচিত সরকার। তবে কার জন্য স্বাধীন হল এই দেশ!

১৯৪৭-এর ১৪ অগস্ট মধ্যরাতের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘যে, যে ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই সমান ভাবে ভারতের সন্তান, আমাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান দায়িত্ব আছে।’’ অথচ এই অঙ্গীকার রক্ষা করা তো দূরের কথা, দেশ জুড়ে এখন এক অযুক্তি ও অমানবিকতার প্লাবন। তাই স্বাধীনতা দিবসে মহা সমারোহে তেরঙা বেলুন ওড়ানোর আগে আমরা কি এক বারও ভারত আত্মার গভীরে গিয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করব না! ভারতের বহুমাত্রিক সত্তাকে স্বীকার ও গ্রহণ করে, ভারতাত্মাকে উদ্ধারের লড়াইয়ে হাত বাড়িয়ে দেব না!

১৪ অগস্ট মধ্যরাতে নেহরুর বক্তৃতা সংবিধান পরিষদে।

কিন্তু কী ভাবে খুঁজে পাব সেই ভারত আত্মার সন্ধান! কোনটা আমার স্বাধীনতা! কোনটা আমার দেশপ্রেম! আসলে সবটাই যেন গুলিয়ে দেওয়া হয়, মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেওয়া হয় দেশপ্রেম ও নাগরিকের স্বাধীনতা। অস্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের চিন্তা ভাবনার অলিগলি। আমরা হেরে যেতে থাকি রাষ্ট্রের এই গভীর চক্রান্তের কাছে।

এখন আর আমরা অবাক হই না, যখন ক্রিকেটে ম্যাচে পাকিস্তানকে হারাতে পারলেই পাড়ায় পাড়ায় অকাল দিওয়ালি শুরু হয়ে যায়। যখন স্বাধীনতা দিবসের দিন একের পর এক ‘রোজা’, ‘বর্ডার’, ‘লক্ষ্য’, ‘এলওসি কার্গিল’— এমনতর সব সিনেমা টেলিভিশনে চলতে থাকে— কী ভাবে যেন দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার ফারাকটুকু মুছে যেতে থাকে। মনে হয়, এত কষ্টে অর্জন করা আমাদের স্বাধীনতার নির্যাস কি তবে একমাত্র পাকিস্তান বিরোধিতা!

স্মার্ট ফোন মুঠোতে নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে শেয়ার করতে থাকি দলিতহত্যা, কৃষকের আত্মহত্যা, গোরক্ষক বাহিনীর হাতে সংখ্যালঘুর হত্যা, আদিবাসী রমণীর নগ্নদেহে কালশিটে দাগ, বুদ্ধিজীবীদের গায়ে সেঁটে দেওয়া রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা নিয়ে নানা পোস্ট।

স্বাধীন ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগুরুর দ্বারা সুরক্ষিত হবে সংখ্যালঘুর স্বার্থ। অথচ একটি কালির আঁচড়ে যখন ভিটেমাটি হারা হয় লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু মানুষ এবং বছরভর তাদের আতঙ্কে রাখা হয়, কিম্বা নতুন মর্যাদা পাওয়া জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের স্বাধীনতার খবরের সত্যতা কতটুকু, তা জানার অধিকার থাকে না বাকি দেশবাসীর— তখন ১৫ অগস্ট, এই স্বাধীনতা দিবস ক্যালেন্ডারে একটি প্রতীকী ছুটির দিন ছাড়া আর কিছু নয়।


(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)

ভারতের অগণিত নারীর কাছে স্বাধীনতা আজও একটি সোনার পাথরবাটি। রাসসুন্দরী দেবী উনিশ শতকের মাঝামাঝি ওঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন, মায়ের মৃত্যু শয্যায় ওঁকে দর্শন করতে পারেননি। সেই আক্ষেপ তাঁর ছিল চির দিন। তিনি লেখেন, ‘‘আমি যদি পুত্র সন্তান হইতাম, তবে আমি যেখানে থাকিতাম পাখির মতো উড়িয়া যাইতাম। কী করিব, আমি পিঞ্জিরাবদ্ধ বিহঙ্গ।’’

অগস্ট, ২০১৯— মনামি মিত্র তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন— সংসারের পরিস্থিতিতে মন ভাল নেই, মাস্টার ডিগ্রির পরেও তিনি পড়া চালিয়ে যেতে চান, কিন্তু স্বামী তাঁর পাশে নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যার পথই বেছে নিলেন।

প্রায় দেড়শো বছরের ব্যবধানে এই দু’টি সামাজিক চিত্রের মধ্যে কি খুব একটা বদল ঘটল? রাসসুন্দরী দেবী যথার্থই বলেছিলেন, পাখির মতো উড়িয়া যাওয়া অর্থাৎ সাবলীল নির্ভার এক স্বাধীন উড়ান আজও আমাদের দেশে এক নারীর ভাগ্যে অতি দুর্লভ স্বপ্ন মাত্র।

তবু এত কিছুর পরেও আশার আলো ঝলমল করে ওঠে যখন তরুণ প্রজন্মের এক যুবা প্রতিনিধি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘‘বাস্তবের প্রচলিত অর্থে হয়ত ঔপনিবেশিকতা নেই, কিন্তু আছে মেধা ও পুঁজিবাদের ঔপনিবেশিকতা। সেটা থেকে মুক্তি পেতে চাই।’’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র যখন বলে, ‘‘আমি চাই দেশ যেন আমায় দেয় নির্মল তাজা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার অধিকার। তবেই স্বাধীনতা সার্থক আমার কাছে।’’

আবার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর কথায় স্বাধীনতা হল, ‘‘নির্ভয়ে ইচ্ছে মতো যেখানে খুশি চলাফেরা করার অধিকার। মেয়ে বলে যেন হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়।’’

তরুণ প্রজন্মের এই আত্মবিশ্বাস ও স্পষ্ট ধারণা নতুন করে উদ্দীপনা জাগায়। মনে হয়, ১৫ অগস্টের এই প্রতীকী দিনটিতে যেন শপথ নিতে পারি, আমরা বুক দিয়ে যেমন আগলে রাখব আমাদের প্রিয়তম দেশকে, তেমনই আকণ্ঠ ডুবে থাকব পরিপূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতায়।