রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা মেট্রো আমাদের বড় সাধের। ভীষণই গর্বের। দেশের প্রথম মেট্রো বলে কথা! শহরের একমাত্র লাইফলাইনও বটে। কিন্তু, এই গৌরবের দোহাই দিয়ে তো আর নিজের বিপন্ন প্রাণের আশঙ্কাটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না।
বৃহস্পতিবার যে ঘটনা ঘটে গেল, তার পরে মেট্রোয় ওঠার কথা আর ভাবতেই পারছি না। বারে বারেই শিউরে উঠছি এই ভেবে, সুড়ঙ্গের মধ্যে কী ভাবে আধ ঘণ্টা ওই মানুষগুলো কাটালেন!
বাইরে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। ভিতরে এসি-আলো সব বন্ধ। এক দল যাত্রী দরজা-জানলার কাচ ভেঙে বাইরে বেরনোর চেষ্টা করছেন। প্রচুর মানুষ শ্বাসকষ্টে ধুঁকছেন। কেউ কাঁদছেন। কেউ চিৎকার করছেন। কেউ ফোনে পুলিশ বা মেট্রো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। গোটা মেট্রো জুড়ে শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি।
মেট্রো রেকের তলায় আগুন, কামরায় ধোঁয়া, আধ ঘণ্টা আটকে যাত্রীরা অসুস্থ
কিন্তু সেই আকুতি মেট্রো কর্তৃপক্ষের কান অবধি পৌঁছচ্ছে না। ওই আধঘণ্টায় মেট্রোর তরফে কোনও ঘোষণা করা হয়নি। কী হয়েছে, কী ভাবে যাত্রীরা ওই রকম একটা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবেন তার যথাযথ গাইড তো পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা করা যেত! সে সব তো দূরের কথা, ওই রকম একটা সময়ে যাত্রীদের ঠিক কী করা উচিত সেটাও কি মেট্রো কর্তৃপক্ষ কোনও দিন জানিয়েছেন!
ঘটনার পর কলকাতা মেট্রো রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে অ্যাটিটিউট টিভির পর্দায় শোনা গেল, তাতে তো মনে হল কোনও মালগাড়িতে আগুন লেগেছে। আদৌ মেট্রোর যাত্রীদের নিয়ে তাঁদের কোনও ভাবনা আছে? মনে তো হল না। তাঁরা শুধু দায়-দায়িত্ব এড়িয়েই খালাস। এতগুলো মানুষ যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ দেখে ফিরল, তাঁদের জন্য বিন্দু মাত্র সহানুভূতি দেখা গেল না ইন্দ্রাণী দেবীর গলায়। মেট্রো রেলের জেনারেল ম্যানেজারের কথা শুনেও মনে হল, একটা তদন্ত কমিটি গড়ে দিতে পারলেই হয়তো তাঁর দায় শেষ হয়ে যায়!
এ দিন যে ঘটনা হয়েছে, তা মোটেও নতুন কোনও বিষয় নয়। এর আগে একাধিক দিন এমন ঘটনা ঘটেছে। এখনও পর্যন্ত সেই সব ঘটনায় কারও প্রাণহানি হয়নি। সে কারণেই কি আগের ঘটনাগুলি থেকে মেট্রো কর্তৃপক্ষ কোনও শিক্ষা নেননি? আসলে যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টাকে ভীষণ লঘু চালে দেখছেন তাঁরা। এ ভাবে লাইফ লাইন চালানো কি আদৌ সম্ভব!
নির্ধারিত সময়ে মেট্রো চলার ঘটনা এখন বেশ বিরল। ভাঙাচোরা, মান্ধাতা আমলের রেক দিয়ে পরিষেবা দেওয়া হয়। আচ্ছা কোন যাত্রী মাথার দিব্যি দিয়েছেন, পাঁচ মিনিট অন্তর মেট্রো চালাতে হবে! যদি চালানোর মতো রেক না থাকে, তা হলে সময়টা তো আরও বাড়িয়ে দেওয়াই যায়। তাই বলে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায় না!
মেট্রো এখনও নিজস্ব কোনও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী তৈরি করে উঠতেই পারল না, যারা এমন পরিস্থিতিতে অতি দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়বে। মাঝ সুড়ঙ্গে মেট্রোর তলায় আগুন লেগে যাচ্ছে, রেকটা দাঁড়িয়ে পড়ছে, কামরা ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে, মানুষজন শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়ার উপক্রম— আর আধ ঘণ্টা পরে যাত্রীদের উদ্ধার করা হচ্ছে! এতটা উদাসীন মেট্রো কর্তৃপক্ষ!
মেট্রো ভাড়া কি যাত্রীরা নির্ধারণ করেন? জবাবটা না। তা হলে সঠিক মূল্য দিয়ে টিকিট কেটে ন্যায্য নিরাপত্তাটুকু তো দাবি করতেই পারেন যাত্রীরা। মেট্রোর যদি ভাঁড়ে মা ভবানী পরিস্থিতি হয়, তা হলে ভাড়া বাড়িয়েও তো নিরাপত্তা খাতে আরও কিছু বরাদ্দ করা যায়। সেটা কেন করেন না মেট্রো কর্তৃপক্ষ! কেন প্রতিটা স্টেশনে মেট্রোর নিজস্ব বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী থাকবে না! কেন এমন পরিস্থিতিতে মেট্রোর ভিতরের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে প্রয়োজনীয় পরামর্শ শোনানো হবে না! কেন এটুকুও ঘোষণা করে বলা হবে না, ঠিক কী হয়েছে!
এত শত ঘটনার পর উদাসীন মেট্রো কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে কলকাতার এই লাইফ লাইন থেকে যদি এর পর মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়! জীবনকে বাজি রেখে কেউ যদি মেট্রোয় কেউ না উঠতে চায়! কী করবেন তখন কর্তৃপক্ষ? সাধা লক্ষ্মী এ ভাবে পায়ে ঠেলার কারণটা ঠিক কী বোধগম্য হচ্ছে না এখনও।
An incident of fire between Rabindra Sadan and Maidan around 5pm. The fire put off by our staff through water from fire hydrants. West Bengal fire service & Kolkata Police disaster management group are attending. All passengers have been safely evacuated by 6pm. Pl do not panic.
— METRO RAIL KOLKATA (@metrorailwaykol) December 27, 2018