পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমাকে মানুষের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন: তিস্তা

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বাংলা সিনেমাকে একটা সময় উজাড় করে দিয়েছেন। তাঁর তৈরি একটার পর একটা ছবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সাড়া ফেলেছে। বাংলা, হিন্দি সিনেমার জগত জুড়ে অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অজস্র স্মৃতি তাঁকে ঘিরে। তাঁর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তিস্তার ছোট স্মৃতি। তাঁর নারী হয়ে ওঠার পথে তাঁকে এগিয়ে দেওয়ার স্মৃতি। সেই তিস্তাকে ক্যামেরায় ধরেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আজ তাঁর প্রয়াণের খবরে অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে তিস্তার। সেই কথাই উঠে এল তাঁর কলমে। লিখলেন তিস্তা দাস


তখনও আমার খরখরে বালি-পাথরের মতো অমসৃণ ত্বক নিয়ে লুকোচুরি বেঁচে থাকা। সারা মুখে গজিয়ে ওঠা শুঁয়োপোকার আলের চেয়েও তীক্ষ্ণ লোম প্রতি দিন আমায় চরম অস্বস্তি দিয়ে চলেছে। তখনও আমার শরীরের লিঙ্গ চিহ্ন ‘নারী’ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়নি। তখনও নারী-পোশাকের অন্তরালে আমি এই ‘সুশীল’ সমাজের চোখে ‘ব্যাটাছেলে’ হয়েও ‘মেয়ে সেজে’ ঘুরে বেড়ানো এক ‘অদ্ভুত-জীব’।

বাল্যবান্ধবী শান্তা ঘোষের চেষ্টায় সবেমাত্র অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর দৈনিক ‘খবরের কাগজ’-এ চাকরি পেয়েছি। প্রুফ রিডার। আমার লিঙ্গ পরিচয়ের সবটুকু জেনেই সেই সমেয় ওঁরা চাকরিতে নিয়েছিলেন। শান্তারই ক্রমাগত অনুরোধে শেষমেশ রাজি হয়েই ফোনটা করে ফেলেছিলাম। বুদ্ধদেবদাই ধরেছিলেন ফোন। জানতে পেরে আপাদমস্তক শিহরিত আমার গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। কী ভাবে কথাটা বলব! বুঝে ওঠার আগে উনিই বললেন, ‘‘বলুন, কী বলতে চান?’’

ভয়ে-ভয়ে, আশা-নিরাশায় তিরতির কাঁপতে কাঁপতে জানিয়েছিলাম, ‘‘আপনার সঙ্গে সঙ্গে দেখা করতে চাই। লিঙ্গান্তরকামী মানুষদের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে একটা ফিল্ম তৈরির বিষয়ে আলোচনার জন্য।’’ পরের দিনই ডেকে পাঠালেন ওঁর গোলপার্কের অফিসে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন সমস্ত বিষয়টা। সেখানে ছিলেন বুদ্ধদেবদার সহকারী সোহিনী দাশগুপ্ত এবং প্রোডাকশন ম্যানেজার প্রবালদা (ভৌমিক)। প্রথমটা ওঁর সংশয় ছিল প্রবল। আদৌ দর্শক মিলবে তো এ ছবির? এমন বিষয়ে নির্মিত ছবির প্রযোজকই বা জুটবে কী ভাবে? তার উপরে লিঙ্গান্তরকামী মানুষদের জীবন-যন্ত্রণার হদিশও যে খুব একটা রাখতেন বুদ্ধদেবদা, তা-ও নয়। বার বার প্রশ্ন করছিলেন, ‘‘এই বিষয়ে ছবি করতে গেলে কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজ কে করবেন? তাঁকে আমি পাব কোথায়?’’

আমার লেখা কবিতা পড়ে, আমাকে দেখে উনি কি সত্যিই বোঝেননি আমার বিভক্ত লিঙ্গ পরিচয়ের ইশারা?

যদি ছবিটা তৈরি না হয়, সেই আশঙ্কা থেকে অস্বস্তির ল্যাজা-মুড়ো সব খেয়ে বলে ফেলেছিলাম নিজের কথা। শুনে দার্শনিকের মতো কিছু ক্ষণ চুপ করেছিলেন। তার পর বলেছিলেন, ‘‘আচ্ছা, তোমাকে কিছু দিন পর জানাচ্ছি।’’

বাদামী ধোঁয়ার মতো ঘন হতাশা নিয়ে সে দিন ফিরে এসেছিলাম। তার বেশ কয়েক দিন পর হঠাৎ ফোন এল পাশের বাড়িতে। বুদ্ধদেবদার ফোন। জানালেন, একটা শর্তেই উনি ছবিটা করতে রাজি। যদি আমি কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজ করতে রাজি হই। সে যেন কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার অনাবিল আনন্দ। কিছু দিন আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, একটি তথ্যচিত্র তৈরি করবেন আমার উপর। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আই কুড নট বি ইয়োর সান, মম’। নির্দেশনায় সোহিনী। প্রযোজক, স্বয়ং বুদ্ধেদবদা।

‘আই কুড নট বি ইয়োর সান, মম’ ছবির দৃশ্যে তিস্তা।

ছবিটি নন্দন-এ মুক্তি পেয়েছিল আজ থেকে প্রায় বছর দশ-বারো আগে। তার পর থেকেই মিডিয়া কভারেজের দৌলতে সমাজের চোখে ‘ব্যাটাছেলে’ হয়েও ‘মেয়েছেলে সেজে’ ঘুরে বেড়ানো সে দিনের আমি সকলের চোখে মনুষ্য পদবাচ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। তার পর থেকেই আমায় এক সময় ‘ছক্কা’, ‘মওগা’ বলে এন্তার খিস্তি দেওয়া লোকজনদের আমার প্রতি আদিখ্যেতা, ভালবাসা উথলে উঠতে শুরু করেছিল। কী ভন্ডামো ভাবা যায়!

আমাকে সমাজের চোখে ‘মানুষ’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাওয়া মানুষটা আজ সকালে চলে গেলেন। না ফেরার দেশে। জীবনের উপান্তে এসে তাঁর দীর্ঘ রোগভোগের মাঝেও আমাদের আর দেখা হয়নি। অনেক চেষ্টার পরেও। কেন সে জবাব আমাকে আজও ভাবায়। নিজের জন্মদিনের এক গোধূলি বিকেলে সোহিনী এবং আমার সঙ্গে দেওয়া অনাবিল আড্ডায় উনি বলেছিলেন, ‘‘অভিনয়টা ছেড়ে দিয়ো না তিস্তা। তোমার মধ্য অনেক সম্ভাবনা।’’

আমি এক পাহাড় অভিমানে, পেটের ভাত জোগাড়ের নিরন্তর লড়াইয়ে ক্লান্ত হতে হতে আজ অভিনয় ছেড়ে বহু দূর হেঁটে এসেছি বুদ্ধদা। বুদ্ধদা, এই হিংস্র শিল্পের পরিকাঠামো আমার সেই সম্ভাবনাময় জীবনের মুখে পেচ্ছাব করে দিয়েছে ক্রমাগত। আমি তিষ্টতে পারিনি। আমার এই অক্ষমতা কি মার্জনীয় নয় বুদ্ধদা?

এই মৃতের স্বদেশ থেকে অনেক দূরে তুমি খুব ভাল থেকো।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)