একটি আত্মহত্যা ও একটি ভাবনা, নতুন করে জাগিয়ে দিলেন সুশান্ত

একটি আত্মহত্যা

একটি আত্মহত্যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রায় কোনও প্রশ্নেরই জবাব মেলে না। আসে যে জবাব দিতে পারতেন তিনিই তো আর নেই। তবুও ভাবনারা ঘিরে ধরে। ঠিক যেভাবে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন সুশান্ত সিং রাজপুত, লিখলেন সাহানা মল্লিক চক্রবর্তী


রবিবার দুপুর থেকেই একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে, “মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো/ মর্গে— গুমোটে/ থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে?’’ তার থেকে এই সোনালি রঙের রোদ, নীল আকাশ, নিকষ কালো আকাশে টেলিস্কোপের লেন্সে ধরা পড়া তারাদের রূপকথা— এই কি ভাল ছিল না! তা হলে কেন এ সব ছেড়ে ‘লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে’ শুয়ে থাকা টেবিলের ’পরে।

কোন ‘বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে’? যে ক্লান্তির হাত থেকে মুক্তি পেতেই গ্ল্যামারের দুনিয়া, সাফল্যের মোহ, চাঁদের বাড়ির স্বপ্ন আরও আরও কিছু করা বা পাওয়ার মোহ ছে়ড়ে পাড়ি দিতে হল তারাদের দেশে? মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই!
সবই তো ছিল, তবু কেন এমন মৃত্যু? সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রশ্নটা অনেকেই করেছেন দেখলাম।

উত্তরটা বোধ হয় আমাদের সকলেরই জানা। তবু আমরা না জানার ‘ভান’ করি। হ্যাঁ, এই ভান করেই তো আমরা জীবনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সুখের ভান, ভালবাসার ভান, বড়লোক হওয়ার ভান, সফল হওয়ার ভান, ভাল লোক হওয়ার ভান! এমন কত সব ‘ভান’ করতে করতেই আমরা আসলে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছি মনে মনে। সেই ক্লান্তি নেই লাশকাটা ঘরে। তাই কি অমন থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো মৃত্যু বেছে নেওয়া?

ইনস্টাগ্রামে লক্ষ লক্ষ অনুগামী। আর ব্যক্তিগত জীবনে শুধুই একের পর এক সম্পর্কের ভাঙন। মনের মানুষ খুঁজে না পাওয়া! বলা ভাল, ব্যথার ব্যথী খুঁজে না পাওয়া। সাফল্যের ঘরে নিরাপত্তাহীনতা! অবিরাম খোঁজা আর না পাওয়া! আর তা থেকেই ক্লান্তি।

আচ্ছা, এটা কি শুধুই সুশান্ত সিং রাজপুতের গল্প? আমাদের মতো আম আদমিদেরও কি গল্প নয়! ফেসবুক, ইনস্টা-তে হাজার হাজার বন্ধু! তবু মনের ঘরে সেই তো আমরা একা। একাধিক ব্যক্তি লিখেছেন দেখলাম, ‘‘অবসাদগ্রস্ত হলে আমার সঙ্গে কথা বলুন। মনের কথা শুনব। কিন্তু আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন না।’’ প্রস্তাবটা নিঃসন্দেহে ভাল, কিন্তু আজকালকার বদলে যাওয়া সমাজে, বদলে যাওয়া মনের গহীন কথাটা কেউই কি প্রাণ খুলে অন্যের কাছে তুলে ধরতে পারবে! আমার ব্যথাটা কেউ কি আমার মতো করে বুঝতে পারবে?

আমরা ফেসবুক, ইনস্টা-তে স্টেটাস দিই, কত সুখে আছি! সেখানে ফেসবুকেরই কোনও বন্ধুর কাছে নিজের দুর্বলতাগুলি তুলে ধরাটা কি আদৌ সম্ভব! থাকল না হয়, ফেসবুকের কথা! পরিবারে? সেখানেও তো ধরেছে ভাঙন। আমরা মধ্যবিত্তরাও তো সাধারণ জীবনযাপন করতে ভুলে গিয়েছি। অমুক ফেসবুকে ইউরোপ ট্যুরের ছবি দিয়েছে। তো আমাকেও কিছু একটা দিতে হবে। না হলে পিছিয়ে পড়ব যে! লাইক-কমেন্ট-এ সম্পর্কের মরা-বাঁচা নির্ভরশীল। সেখানেও আবার হিংসা। এর আবার আহামরি একটা নামও আছে, ডিজিটাল হিংসা। অন্যের গালভরা স্টেটাস দেখে কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখানোর নাম ডিজিটাল হিংসা। এমন আরও কত হিংসার যে শিকার আমরা।

আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

আমরা যত স্মার্ট হয়েছি, আধুনিক হয়েছি, যত টেক স্যাভি হয়েছি, ততই সরে গিয়েছি আমাদের শিকড়টা থেকে। কাছের মানুষগুলোর থেকে। পুরনো বড় বড় বাড়ি ভেঙে উঠছে পেল্লায় হাউসিং কমপ্লেক্স। সেখানে ছোট ছোট খুপরি ফ্ল্যাটে জায়গা শুধুই একটি অণু পরিবারের। জায়গা সীমিত, ঘোরাফেরা সীমিত, আলো-বাতাস সীমিত, মনের পরিসরও সীমিত। আগের একান্নবর্তী পরিবারের সেই সদস্যরা আজ বহুভাগে বিভক্ত। শুধু সংসার নয়, মনও ভাঙতে ভাঙতে খণ্ড-বিখণ্ড। সবাই ব্যস্ত, ইঁদুর দৌড়! পেতে হবে, পেতে হবে! প্রথম হতে হবে, সকলের কাছে পয়সাওয়ালা দেখাতে হবে। বাবা-মা ছুটছে আরও পয়সা চাই, আরও আরও! সন্তান ছুটছে প্রথম হতে হবে। না হলে কাকার ছেলেটি প্রথম হয়ে গেলে আমি পিছিয়ে পড়ব, নয়তো প্রতিবেশীর ছেলেটি এগিয়ে গেলে বাবা-মা মুখ দেখাতে পারবে না। ছুটছে সবাই! ছুটছে সময়ও!

আর এ ভাবে ছুটতে ছুটতেই বেরিয়ে যাচ্ছে, আসল সময়টা। দু’দণ্ড সময় নেই পরিবারের সঙ্গে কাটানোর মতো। বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে, নয়তো সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের এককোণে ঠাঁই। নাতি-নাতনির সময় নেই দাদু-দিদার সঙ্গে সময় কাটানোর। ভাই-বোনের সময় নেই পরস্পরের সঙ্গে নিখাদ আড্ডা দেওয়ার। সেখানেও তো প্রতিযোগিতা, মনের কথা প্রকাশের জায়গা কোথায়! সব-সম্পর্কেই তো প্রতিযোগিতা। অবস্থার, সামর্থ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এক ভাই উন্নতি করলে আর এক ভাইয়ের আনন্দ নয়, বরং বাড়ে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার শিকার ছোট ছোট শিশুগুলিও। তাই, বাড়ছে অবসাদ। এর শিকার শৈশবও। একান্নবর্তী পরিবারে বরাদ্দ একটিমাত্র ঘরে থেকে শত অশান্তির মধ্যেও তুতো ভাই-বোনেদের মধ্যে যে ভালবাসাটুকু ছিল, আজ ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা ঘরে সেই আন্তরিকতা কোথায়!

এই সাফল্য, এই ছুটে চলা, এর মাঝে যদি কোথাও একটু তাল কাটে, তখনই আশঙ্কা। ওই যে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা। সামর্থ্যের অধিক প্রতিযোগিতায় নেমে তাল সামলাতে না পারার আশঙ্কা। এ থেকেই ডিপ্রেশন, যার চরম পরিণতি, ওই লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা।


আন্তরিকতার অভাব, অন্তরঙ্গ বন্ধুর অভাব, মনের মানুষের অভাব, ব্যথার ব্যথীর অভাব। জীবনের প্রতিযোগিতায় নেমে এতগুলো অভাববোধ আমাদের মনকে একলা করে তুলছে। আমরা, কেরোসিন শিখারা চাঁদকেই দাদা বলে ডাকতে চাই। টিমটিম করে জ্বলা মাটির প্রদীপের সঙ্গে আত্মীয়তা, বন্ধুতা কোনওটাই ঠিক চলে না। তাই, আমরা চাইলেও, সমাজ বদলাবে না। আমরা চাইলেও আমাদের তুতো ভাই-বোনেদের সেই নিঃস্বার্থ ভালবাসা আর ফিরে আসবে না, আমরা চাইলেও রোদ্দুর হতে না পারা অমলকান্তিরা অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করে বড়লোক বন্ধুর সঙ্গে অবলীলায় মনের কষ্টের কথা তুলে ধরতে পারবে না। ভার্চুয়াল বন্ধুর সঙ্গে তো নয়ই!

একা করণ জোহরকে বয়কট করে লাখো লাখো মানুষের মানসিকতার বদল হবে না। আরও অসংখ্য সুশান্ত সিং রাজপুতরা আমাদের আশেপাশেই রয়েছে, থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো মৃত্যু বেছে নেওয়ার অপেক্ষায়! তাদের কে রক্ষা করবে? মনের হদিশ তারা কেনই বা দেবে ভার্চুয়াল লাইক-কমেন্টের বন্ধুদের! এগিয়ে আসতে হবে কাছের মানুষদেরই! প্রতিযোগিতা ছুড়ে ফেলে সহানুভূতির হাতটা এগিয়ে দিতে হবে আপনজনদেরই। তাতে কি আদৌ আমরা আগ্রহী?

করোনা মহামারির টিকা এক দিন না এক দিন ঠিকই আবিষ্কার হবে, কিন্তু অবসাদ মহামারি ঠেকানোর জন্য আমাদের সমাজ কি আবার ফিরবে আগেকার শান্তির দিনগুলিতে! পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধন কি আবার মজবুত হবে, ভালবাসার নিরাপত্তায়!

বদল হবে না।

তারাদের দেশে শান্তিতে থাকো সুশান্ত সিং রাজপুত!

 

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)