‘সুনীল আপনি এ বার ফুটবলটা ছেড়ে দিন’

Sunil Chhetri

অনির্বাণ বাগচী
(ফুটবলপ্রেমী)


সুনীল আপনি বরং ফুটবল খেলাটা ছেড়েই দিন। এত বিনয় ফুটবলে মানায় না।

একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। তিনটে বিদেশি দল। হোক না সে নিউজিল্যান্ড বা কেনিয়া বা চিনা তাইপে! কিন্তু, ফুটবলই তো খেলে তারা!

প্রথম ম্যাচেই আপনি হ্যাটট্রিক করবেন চিনের বিরুদ্ধে। দুর্দান্ত সেই তিনটে গোল। দেশের হয়ে ৯৯তম ম্যাচে ওই রকম একটা খেলার পর আপনি রাতে একটা আজব কাণ্ড করে বসলেন! একেবারে নতজানু ভঙ্গিমায় এক ভিডিয়ো-আর্জি জানালেন! সকলকে বললেন, মাঠে আসুন।

সুনীলের পর বিরাট, আবেদন মাঠে যাওয়ার

খেলা দেখতে দর্শকদের তো আসতে বলতেই পারেন। কিন্তু ভুলে গেলেন, কয়েক মিনিট আগেই আপনি, হ্যাঁ আপনিই হ্যাটট্রিক করেছেন মুম্বই স্পোর্টস এরিনায়। হাতে গোনা যে ক’জন দর্শক এবং সাংবাদিককুল ছিলেন, তাঁরা জানেন দেশকে আপনি কী মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন! সেখান থেকেই উন্মাদনা শুরু হয়েছিল আপনার ১০০তম ম্যাচ নিয়ে। অথচ রাতেই… সেই আপনিই… হাত জোড় করে সকলকে মাঠে আসতে বললেন। বাঘের মতো মাঠে দাপিয়ে বেড়িয়ে, প্রতিপক্ষকে তিন গোলে কোণঠাসা করে যে সুনীল সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন, হোটেলের রুমে বসে রেকর্ড করা ভিডিয়োতে যাকে দেখা গেল, তিনি কি সেই একই ব্যক্তি?

আর আপনার সেই আর্জিতে যেন অনুমোদন দিলেন বিরাট কোহলি। বিজ্ঞ-দাদার মতো তিনি সকলকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘আপনারা মাঠে এসে আমাদের ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ান। আমি জানি, ওরা কতটা পরিশ্রম করে। ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে সব রকম খেলাকেই সমর্থন করতে হবে।’’ লজ্জা লাগল! জানেন, হ্যাঁ সুনীল আপনাকে বলছি, লজ্জা লাগল। ফুটবলকে উপেক্ষা করে যে ক্রিকেটকে ‘আমরা’ প্রায় জাতীয় খেলার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি, সেই ক্রিকেটেরই শরণাপন্ন হতে হল আমাদের গর্বের ফুটবলকে! হ্যাঁ, আপনাকেই দায়ী করছি।

সুনীল ছেত্রী

মাঠে হাজির ভাইচুং, বিজয়ন, প্রফুল পটেল, সঞ্জয় সেন।

অথচ বিরাটের মতো আপনিও দেশের হয়েই খেলেন। এ দেশের বহু ফুটবলপ্রেমী যখন মেসি বা রোনাল্ডো বলে গলা ফাটান, তখন তাঁরা হয়তো জানেন না, এই আপনিই বিশ্ব ফুটবলে আন্তর্জাতিক গোলের নিরিখে ওই মেসি, রোনাল্ডোর ঠিক পরেই রয়েছেন এই মুহূর্তে। ওঁরা নিশ্চিত জানেন না। কারণ, জানলে আপনাকে এমন নতজানু হয়ে দর্শকদের কাছে আর্জি জানাতে হত না, ‘‘প্লিজ আসুন।’’

আপনি ওই ভিডিয়োয় বলছিলেন, ‘‘মুম্বইয়ে যাঁরা মাঠে এসে খেলা দেখেছিলেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। তবে আমার এই ভিডিয়ো আপনাদের জন্য নয়। যাঁরা মাঠে আসেননি, তাঁদের জন্য। তাঁদের কাছে আমার আবেদন, দয়া করে মাঠে আসুন। দুটো কারণের জন্য আসবেন। এক, এটা বিশ্বের সেরা খেলা। দুই, আমরা দেশের জন্য খেলি।’’ নিজের জার্সিটা হালকা টেনে ধরে যখন এই ‘দেশের হয়ে খেলা’র কথা বলছিলেন, তখন, দীর্ঘ দিনের ফুটবলপ্রেমী হিসাবে চোখটা কেমন ভিজে গিয়েছিল। আপনার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কেন? কেন আপনি এ ভাবে নতজানু হবেন? আপনি সুনীল ছেত্রী। নিজের পরিচয়টা ভুলে গেলেন?

আপনার আর্জিতে, নাকি বিরাটের অনুমোদনে, জানি না, বর্ষামুখর মুম্বই ভরিয়ে দিয়েছিল স্পোর্টস এরিনার স্টেডিয়াম। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গোটা স্টেডিয়াম আপনার দুর্দান্ত সেই দু’গোল দেখেছে। কিন্তু, কেন জানি না বার বার মনে হচ্ছিল, ক্রিকেটের কাছে আমরা আবারও পাঁচ গোল খেলাম। সচিন বা বিরাটরা অনুমোদন না-করলে আমাদের ফুটবলটা ঠিক যেন খেলা হয়ে ওঠে না। পিছিয়ে পড়ছি জানেন। বার বার পিছিয়ে পড়ছি। ক্রিকেটের কাছে প্রতি দিন হারছি।

সুনীল ছেত্রী

সুনীলের হাতে ১০০ নম্বর জার্সি তুলে দিচ্ছেন দেশের দুই সেরা স্ট্রাইকার ভাইচুং ও বিজয়ন।

আপনি দিল্লির ছেলে। কিন্তু, বার বার মনে হত আপনাকে পাহাড়ি। ১০০তম ম্যাচে পাহাড়ি বিছে ভাইচুং যখন আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন, তখন আপনাকেও কেন জানি না মনে হচ্ছিল… আপনি পারবেন। এফসিকাপ থেকে বিশ্বকাপ— অনেকটা দূর যাবেন আমাদের নিয়ে। আর সেটা যাবেন ফুটবলের জোরেই। কোনও ক্রিকেটের বদান্যতায় নয়। এটা ভুলে যেতে বসেছি আমরা।

আপনি যে আকুলতা নিয়ে দর্শকদের মাঠে আসতে বলেছিলেন, সেই আর্জিটা আসলে ক্রীড়া মন্ত্রকের কাছে করা উচিত সকলের। ফেডারেশনকে এ বার বিদায় জানানো হোক। একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টকে নিয়ে যে ভাবে ছেলেখেলা করা হয়েছে, তাতেও ফুটবলের জাত-কৌলিন্য-মর্যাদা— সব গিয়েছে। কোনও প্রচার নেই। কোনও প্রোমোশন নেই। কোনও ঢাকঢোল নেই। ফেডারেশন আছে শুধু নামেই।

চারদেশীয় টুর্নামেন্ট, অথচ তা কভার করতে দেশের কোনও সাংবাদিক নেই মুম্বইয়ে। হাতেগোনা কয়েক জন মুম্বইকর সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিক! অথচ, এর পর এই ভারতীয় টিম দোহা যাবে এএফসি কাপ খেলতে। সেখানে তাবড় তাবড় দল। হোক, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু, তার আগে এমন ছাপোষা তিনটি দেশকে ডেকে আনার মানে কী! তা-ও আবার দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ মুহূর্তে কোনও কারণে বাতিল হয়ে যায়। শেষে কেনিয়া এসে মান রাখে। ফেডারেশনের এত তাচ্ছিল্য মনোভাব কেন! সেই তাচ্ছিল্য নিয়ে কেউ সরব নন কেন! সুনীল আপনিও কেন চুপ!

সুনীলের পর বিরাট

সুনীল ছেত্রী

দর্শকরা কি আদৌ জানতেন ক্রিকেটশহর মুম্বইতে এমন একটা টুর্নামেন্ট হচ্ছে? আর দর্শক ডাকার কাজটা কি আপনার! ফেডারেশন কি নাকে তেল দিয়ে…

আবারও বলছি, আপনার ফুটবলটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। যেখানে ফুটবল সংস্থাই তাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, সেখানে আপনার মতো প্রতিভাবানের কি দায় বলুন তো! খেলুন না চুটিয়ে ক্লাব ফুটবল, কে বারণ করেছে! ক্রিকেটের বদন্যতায় যে ভাবে মুম্বইতে ফুটবলের মান রাখা হল, আপনারও কি লজ্জা হচ্ছে না সুনীল! এ ভাবে ফুটবল বাঁচবে! না। এ দেশে ফুটবল বাঁচবে একমাত্র ফেডারেশনের সদ্‌গতি হলে।

এ বার সেটার চেষ্টা করুন, প্লিজ!

ছবি: এআইএফএফ-এর টুইটার থেকে।