আয়া রাম গয়া রাম, ভজন লাল থেকে মুকুল রায়, দলবদলুদের রমরমা এখনও

আয়া রাম গয়া রাম

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: আয়া রাম গয়া রাম, এ শব্দবন্ধ ভারতের রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত। রাম এলেন। রাম গেলেন। এখানে রাম নিছকই এক প্রতীকী চরিত্র মাত্র। আর সেই চরিত্রের অবস্থান ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে চিরকালই ছিল। রামের এই আসা-যাওয়া, দলবদল, নতুন দল গঠন, এক দল থেকে অন্য দলে গিয়ে ফের সেই দলে যোগ দেওয়া, আবারও ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিক সন্ন্যাস— এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে। এবং সবটাই সংবিধান স্বীকৃত। কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে, এতে ‘অন্যায়’ হওয়ার কথাও নয়। তবুও লোকে মনে করে, নীতি বলে তো একটা জিনিস আছে। সেই নীতি-নৈতিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাঁরা এক বার হোক বা বার বার দলবদল করেন, তাঁদের প্রতি সাধারণ মানুষের সাধারণত একটু বাঁকা ভাব থাকে। তবে সব ক্ষেত্রে নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।

ভদ্রলোকের নাম গয়া লাল। ১৯৬৭ সালে হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচন হয়। তাঁর অব্যবহিত পরেই এই ভদ্রলোকের নাম গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, গয়া লাল এক দিনে ৯ ঘণ্টার মধ্যে ৩ বার দলবদল করেছিলেন। ইতিহাস মনে রেখেছে গয়া লালকে। কিন্তু ‘ফাদার অব দলবদল’ যদি কাউকে বলতেই হয় তিনি ভজন লাল। ভজনও হরিয়ানার রাজনীতিক। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে আয়া রাম গয়া রাম তো রীতি মতো একটা প্রবাদ হয়ে গিয়েছিল। গিয়েছিল কেন, এখনও সে প্রবাদ রীতি মতো বিদ্যমান ভারতের রাজনৈতিক অভিধানে। হালে এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় হোক বা ভোটের পরে মুকুল রায়ই হোক। দলবদল আজও চলছে। এবং রমরমিয়েই।

গোটা দেশ তো বটেই, আমাদের এই বাংলাও দলবদলের ইতিহাসে মোটেও পিছিয়ে নেই। বিধানসভার ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি করিয়েদের দাবি, এ রাজ্যে দলবদলের প্রথম ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫২-তে। স্বাধীনতার পরে সে বারই রাজ্যে গঠিত হয়েছিল প্রথম বিধানসভা। সেই বিধানসভায় ফরোয়ার্ড ব্লক থেকে জিতে এসেছিলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নেপাল রায়, পঞ্চানন লেট এবং কৃপাসিন্ধু সাহু। কিন্তু তাঁরা চার জন কংগ্রেসে যোগ দেন। সেটাই এ রাজ্যে বিধায়কদের দলবদলের প্রথম নজির। এর পর ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে প্রফুল্ল ঘোষ-সহ ১৮ জন বিধায়ক দল ছেড়ে পিডিএফ নামে নতুন মোর্চা গড়েছিলেন। পরে সেই পিডিএফ থেকে পদত্যাগ করে ৩২ জন বেরিয়ে এসে আইএনডিএফ নামে আরও একটি ফ্রন্ট গড়েন।

একটি বিধানসভার আমলে এত জন বিধায়কের দল বদলানোর আর কোনও নজির নেই। ১৯৭১-৭২ সালে ফরোয়ার্ড ব্লক ছেড়ে কংগ্রেসে গিয়ে বিধানসভার স্পিকার হয়েছিলেন অপূর্বলাল মজুমদার। তৎকালীন প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টি ছেড়েছিলেন চার জন। ১৯৮২ সালে জনতা দল থেকে বেরিয়ে ৭ বিধায়ক গিয়েছিলেন ডিএসপি এবং এসপি-তে।

এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্র থেকে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন মুকুল রায়। তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। কিন্তু ভোটের রেজাল্ট বেরনোর মাসখানের মধ্যেই তিনি তাঁর পুরনো দল তৃণমূলে ফিরে আসেন। বিধায়ক পদ এখনও তিনি ছাড়েননি। ছাড়বেন কি না সেটাও বলেননি খোলসা করে। কিন্তু রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মুকুলকে দলত্যাগ বিরোধী আইনের প্যাঁচে ফেলতে চাইছেন। সে বল যদিও স্পিকারের কোর্টে। যে আইনের কথা শুভেন্দু বলছেন, ১৯৮৫ সালের ৫২তম সংবিধান সংশোধন করে সেটা ঢোকানো হয়। দলবদলের বিকৃত ও সুবিধাভোগী প্রবণতাকে ঠেকাতে। কিন্তু দলবদল ঠেকানো যায়নি।

একটা সময় সরকার ভাঙা-গড়ার জন্য বিধায়করা দলবদল করতেন। সরকার গড়তে নিজের দল ছেড়ে অন্যের দলে যাওয়া, আবার সরকার ভাঙতে সেই দল ছেড়ে পুরনো দলে ফিরে আসা, এ সব চলত। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দলবদলের হিড়িক যেন সর্বসময় লেগে রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেই এই আসা-যাওয়া চললেও মূলত শাসকদলেই লোকের ভিড় বেশি। শাসকদলের বিরুদ্ধে সব সময়েই অভিযোগ ওঠে, ভয় বা প্রলোভন দেখিয়ে দল ভাঙানো হচ্ছে। শাসক দল আবার পাল্টা বলে, সরকারের উন্নয়নের কর্মকাণ্ড দেখেই বিরোধীরা তাদের দলে আসতে চায়। মাঝে মাঝে ওঠে বিরোধীরা ‘দল ধরে রাখতে ব্যর্থ’ অভিযোগও।

আসলে আদর্শ-ভিত্তিক রাজনীতির আর ছিঁটেফোটাও অবশিষ্ট নেই। যাঁরা দল ছেড়ে যাচ্ছেন এবং যাঁরা দলে নিচ্ছেন, দু’দিকেই মূল্যবোধের অভাব রয়েছে বলে মনে হয়। এক ধরনের লোক সব সময়ই শাসক দলের দিকে থাকতে চায়। কিন্তু তাই বলে সকলকে দলে নিতে হবে কেন? তবে দলবদলের এই প্রবণতা দক্ষিণপন্থী দলগুলোতেই বেশি। বামপন্থী দল অনেক বেশি সংগঠন নির্ভর। ফলে অনেকে হয়তো মনে মনে চাইলেও ব্যাপারটা অত সহজ নয়। যদিও এটাও বলা উচিত, বাংলায় ১৯৫২ সালে যাঁরা প্রথম দলবদল করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু বামপন্থী দলেরই বিধায়ক ছিলেন।

আসলে আয়া রাম গয়া রাম প্রবাদ চলে আসছে। এ প্রবাদ থাকবে। যত দিন রাজনীতি থাকবে বাংলায়, তত দিন আয়া রাম গয়া রামরাও থাকবে। শুধু বাংলা কেন, গোটা দেশের রাজনীতিতেই এঁরা থাকবেন।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)