থমকে থাকা লোকাল ট্রেন বদলে দিয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের নিজস্ব গতি

থমকে থাকা লোকাল ট্রেন

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: থমকে থাকা লোকাল ট্রেন বদলে দিয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের গতি। ভোর থেকে মাঝরাত, নিরবচ্ছিন্ন লোকাল ট্রেনের চলাচল সরগরম রাখত এক একটা প্ল্যাটফর্মকে। শুধু কি তাই এই সব স্টেশনগুলোকে কেন্দ্র করে একটা বিস্তীর্ণ এলাকার গতি নিয়ন্ত্রণ করে লোকাল ট্রেন। সে গতি অর্থনীতির যেমন, তেমন জীবনযাপনেরও। লোকাল ট্রেন চলাচল থমকে গিয়েছে, ফলে বদলে গিয়েছে ওই সব এলাকার গতি।

শিয়ালদহ মেন, বনগাঁ এবং দক্ষিণ— এই তিন শাখায় লোকাল ট্রেন চলে। কৃষ্ণনগর, গেদে, রানাঘাট, শান্তিপুর, ডানকুনি, কাকদ্বীপ, ক্যানিং, বজবজ, সোনারপুর, সঙ্গে আবার বারাসত-হাসনাবাদ এবং বনগাঁ-রানাঘাটের আলাদা লাইন রয়েছে। অন্য দিকে, গঙ্গার ও-পারে হাওড়া স্টেশন থেকে পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব রেলের আওতায় রয়েছে একাধিক লোকাল ট্রেনের রুট। আমতা, দিঘা, খড়্গপুর, মেদিনীপুর, বর্ধমান, কাটোয়া— কোথায় না কোথায় পৌঁছে যায় এই লোকাল ট্রেন। আর প্রতিটা রুটেই কত শত স্টেশন। আর সেই সব স্টেশন থেকে জীবন হয়ে ওঠে শহরমুখী। সকালে শহরে এসে দিনের কাজকর্ম শেষে ফের সন্ধ্যা-রাতে বাড়ি ফেরা। কারও সরকারি, কারও বেসরকারি কারও বা ব্যবসা, সকলেই শহরে আসেন। রুজির টানে। রুটির টানে। সেই লাইফলাইন আপাতত করোনার কারণে থমকে। কিছু স্পেশাল ট্রেন চলছে বটে, কিন্তু তাতে সকলের ওঠায় ছাড়পত্র নেই। বিশেষ বিশেষ পেশার কিছু মানুষ উঠতে পারবেন। তা-ও সেই সব বিশেষ ট্রেনের সংখ্যাও বড্ড কম। ধীরে ধীরে বাড়ছে বটে, কিন্তু তাতে ক’জন মানুষই বা শহরে যাচ্ছেন!

নানা পেশার মানুষের আনাগোনা স্টেশনে। এক এক জনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসা। নির্দিষ্ট সময়ের ট্রেন ধরে চলে যাওয়া শহরে। ফের ফিরে আসা এক নির্দিষ্ট ট্রেনে। যাত্রীদের সময় করে প্ল্যাটফর্মেও এক এক সময়ে এক এক রকমের দোকান খোলা। মূলত শিয়ালদহ শাখাতেই এই সব দোকানপাটের সম্ভার বেশি। ভোর বেলা প্রথম ট্রেনের সময় থেকে প্ল্যাটফর্মে খুলতে থাকে চায়ের দোকান। গরম ধোঁয়া ওঠা চা, সঙ্গে নানা ধরনের বেকারি বিস্কুট। কোনও কোনও দোকানে রাখা থাকে পান। সঙ্গে সিগারেট-বিড়ি। প্ল্যাটফর্ম বা ট্রেনে ধূমপানের বারণ থাকলেও, ক’জনই বা মানেন সে নিয়ম। ভোর থেকে প্ল্যাটফর্মে প্ল্যাটফর্মে খবরের কাগজ। সরগরম হয়ে ওঠে— কাগজের হিসেব, গোনা এবং ডিস্ট্রিবিউশনের চোটে।

এর পর বেলা বাড়তেই শুরু হয় রুটি-তরকারি, কচুরি-সব্জি, ডিম-পাউরুটির দোকান খোলার পাট। একটু বেশি বেলা পর্যন্ত চলে এই সব দোকান। এর পর দুপুরের আগে থেকে কোথাও কোথাও প্ল্যাটফর্মে খোলা হয় ভাতের হোটেল। আছে সেলুন। জুতো সারাই। বুক স্টল। লটারির টিকিট। ছাতা সারাই। হরেক মণিহারির পসরা। আরও কত কী! বেলা পড়ার সময় থেকে ফলের দোকান। সন্ধ্যা হতেই চপ-ফুলুরি। কোথাও কোথাও চাউমিন। ফুচকা। রাত বাড়তেই সব দোকান বন্ধ হয়ে আসে। কিছু কিছু খোলা থাকে বটে, তবে সে সব দোকানের মালিকরা প্ল্যাটফর্মেই থেকে যান। তাই দোকানও খুলে রাখেন। রাত বাড়লে যাত্রী কমে। কিছু ভবঘুরে মানুষ অস্থায়ী বিছানা পাততে শুরু করেন, প্ল্যাটফর্মে।

থমকে থাকা লোকাল ট্রেন, এখন সব বন্ধ! কোথায় গেলেন তাঁরা, যাঁরা এত দিন সরগরম রাখতেন প্ল্যাটফর্ম? কোনও দোকান খোলে না। প্ল্যাটফর্মের চেনা ভিড় এখন উধাও। চা নেই। পান নেই। চপ-ফুলুরি নেই। দুপুরের ভাত বা বিকেলে ফলের দোকান, সকাল-সন্ধ্যার সেলুন— সব, সব, সব বন্ধ। স্পেশাল ট্রেনে কাগজ আসে বটে। এখন ভবঘুরেরা শুধু রাতে নয়, দিনেও থাকেন প্ল্যাটফর্মে। সেখানে এখন বসার জায়গায় তাঁদের পাত পড়ে। স্থানীয় কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগী খাবার দিয়ে যায় দু’বেলা। নিরন্ন, অসহায় মানুষের জন্য একটু হাত বাড়িয়ে দেওয়া। যাত্রীদের বসার বেঞ্চে একেবারে ভোজবাড়ির মতো আসন করে বসে দুপুর, রাতে পাত পড়ে। মেনুও ভাল। ভাত-ডাল-আমিষ-মিষ্টি।

সব কেমন বদলে গিয়েছে। থমকে থাকা লোকাল ট্রেন, শশব্যস্ত প্ল্যাটফর্ম এখন নিস্তব্ধ। নৈঃশব্দ্য হেসেখেলে বেড়ায়। ঠিক যেমন করে এক একটা প্ল্যাটফর্মকে কেন্দ্র করে এক এক বিস্তীর্ণ এলাকা শহরে যেতে পারে না। বদলে গিয়েছে তার অর্থনীতির চেহারা। তার জীবনযাপনেও বদল এসেছে। ঠিক তেমন করেই বদল এসেছে প্ল্যাটফর্মের বেঁচে থাকাতেও।

কিন্তু জীবন বেঁচে থাকে। এগিয়ে যায়। একটু অন্য ভাবে হলেও বেঁচে থাকা পিছিয়ে যায় না। বরং এগোতেই থাকে। শুধু গতির বদল হয় মাত্র।


প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)